Thursday, July 24, 2014

আরও হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য উদ্ঘাটন:যুগান্তর

সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকে নতুন করে আরও প্রায় হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে এসব নতুন জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ব্যাংকের মতিঝিল প্রধান শাখা, কারওয়ান বাজার শাখা, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা, জুবলী রোড শাখা এবং বাগেরহাটের চিলমারী শাখায় এসব জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এ নিয়ে বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ল। এর আগে কে
ন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখায় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। বেসিক ব্যাংকের নিজস্ব উদ্যোগে এখন সব কটি শাখায় তদন্ত চলছে। এসব তদন্তে নতুন নতুন জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসছে। ব্যাংকের পুরনো ঢাকার একটি শাখায়ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবহান কয়েক দিন আগে যুগান্তরকে বলেছেন, তারা প্রতিটি শাখায় ব্যাংকের নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত করছেন। এসব তদন্তে কি ঘটেছে তা বেরিয়ে আসবে। একই সঙ্গে প্রত্যেকটি ঋণ গ্রহীতাকে ডেকে সরেজমিন গ্রাহকের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে ব্যাংক। সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক অশোক কুমার দে তার এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ব্যাংকের গুলশান, শান্তিনগর ও দিলকুশা শাখার পাশাপাশি মতিঝিলে ব্যাংকের প্রধান শাখা, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা, জুবলী রোড শাখার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনার সুপারিশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি শাখাগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বেসিক ব্যাংকের প্রায় সব শাখায় কম বেশি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। এ সুযোগে যেমন বেআইনি ঋণ দেয়া হয়েছে, তেমনি অনেক বেনামি প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে এখন উধাও হয়ে গেছে। এদিকে বেসিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত উদঘাটিত সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির মধ্যে জাল দলিল বন্ধক রেখে বেসিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ঋণের টাকায় ব্যবসা না করে জমি কেনা হয়। সেই জমির দলিল মঞ্জুরিকৃত ঋণের জামানত হিসেবে ব্যাংকে বন্ধক রাখা হয়েছে। এ ধরনের ধারাবাহিক জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে বেসিক ব্যাংকের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে ব্যাংকে বন্ধকী জমির দলিল ঋণ আদায় না করেই গ্রাহককে ফেরত দেয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকের হাতে এখন কোনো জামানত নেই। এ ধরনের হাজারও রকমের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বেসিক ব্যাংকে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গ্রাহকের অনুকূলে ঋণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক ঋণের বিপরীতে গ্রাহকের আবেদনপত্রও পাওয়া যায়নি। ঋণ গ্রহীতার আবেদন ছাড়াই ঋণ দেয়ার মতো ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এছাড়া ঋণ মঞ্জুরির আবেদন গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি করে চলতি হিসাব খুলে যাচাই-বাছাই ছাড়াই একদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শাখা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এসব জালিয়াতি ও নেতিবাচক বিষয়গুলোর ওপর ব্যাংকের শাখাগুলোর ক্রেডিট কমিটি আপত্তি জানায়। কিন্তু আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বোর্ডের কাছে প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পেশ করেছে। বোর্ড ত্র“টিপূর্ণ প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশান শাখার ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ, কারওয়ান বাজার শাখার ৮টি প্রতিষ্ঠান, শান্তিনগর শাখার ৫টি প্রতিষ্ঠান, প্রধান কার্যালয়ের ১৪টি প্রতিষ্ঠান ও দিলকুশা শাখা থেকে ১১টি প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়ায় ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়মের সন্ধান পেয়েছে কমিটি। প্রধান কার্যালয়সহ মোট পাঁচটি শাখা থেকে ৫৬টি প্রতিষ্ঠানকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয়। কিন্তু এসব ঋণের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ, ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ কার্যক্রমে নানা ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব ড. এস আসলাম আলম যুগান্তরকে বলেন, আমরা বেসিক ব্যাংকের ওপর একটি ফাংশনাল নিরীক্ষা করেছি। সেখানে কিছু ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। মন্দ ঋণগুলোর ব্যাপারে কি করা যায় সেটি বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, হলমার্কের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, কিছু কিছু ঋণের কাগজপত্র ঠিক ছিল না, মর্টগেজ ঠিক ছিল না, পার্টির কাছ থেকে পরে কাগজপত্র নিয়ে সোনালী ব্যাংক সেগুলো ঠিক করেছে। এক্ষেত্রে যেসব ঋণ ঠিক নেই সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হয়তো অর্থঋণ আদালতে যাওয়া হবে, পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনেও পাঠানো হতে পারে। ড. আসলাম আলম বলেন, এসব বিষয়ে বোর্ড একা এ কাজ করেনি। এর সঙ্গে অনেক কর্মকর্তাও জড়িত আছেন। তাদের শনাক্ত করা হবে। শুলশান শাখার ঋণ বিতরণের অনিয়মের ব্যাপারে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- বেসিক ব্যাংক থেকে মেসার্স বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। দীর্ঘদিনেও ঋণ পরিশোধ না করায় ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। মেসার্স খাদিজা অ্যান্ড সন্সের ঋণ হচ্ছে ২০ কোটি টাকা, ওই ঋণের বিপরীতে অনাদায়ীর পরিমাণ হচ্ছে ২২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। মেসার্স লিটল ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের অনুকূলে ঋণ দেয়া হয় ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের অনাদায়ী সৃষ্টি হয়েছে ৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। মেসার্স এবি ট্রেড লিংকের ঋণ মঞ্জুরের সীমা হচ্ছে ৭৫ কোটি টাকা, ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে অনাদায়ী হয়েছে ৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। মেসার্স রিসোর্স শিপিং লিমিটেডের অনুকূলে ঋণ দেয়া হয় ৫৫ কোটি টাকা, ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের অনাদায়ী দায় হচ্ছে ৬২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মেসার্স এস সুহি শিপিং কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হয় ৪৭ কোটি টাকা, তাদের কাছে অনাদায়ী দাঁড়িয়েছে ৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। মেসার্স এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ঋণ মঞ্জুরি সীমা হচ্ছে ৮৫ কোটি টাকা, তাদের কাছে ব্যাংক অনাদায়ী হয়েছে ১০১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। মেসার্স ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ঋণ দেয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা, কিন্তু ঋণের অনাদায়ীর পরিমাণ হচ্ছে ৬৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। মেসার্স শিফন শিপিংলাইন লিমিটেডের কাছে ঋণ দেয়া হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা, কিন্তু ব্যাংকের অনাদায়ীর পরিমাণ হচ্ছে ৬৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। মেসার্স ওসান অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেডের অনুকূলে মঞ্জুরের প্রথম কিস্তি ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ওই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অনাদায়ীর পরিমাণ হচ্ছে ৪৬ কোটি টাকা, একই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দ্বিতীয় দফায় আরেকবার ঋণ দেয়া হয়েছে ৯১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া মেসার্স প্রাসার্দ নির্মাণ কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হয় ৫৩ কোটি টাকা, ওই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংকের অনাদায়ী হয়েছে ১৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। মেসার্স সুন্দরবন ফিশ কালচারের ঋণের সীমা হচ্ছে ৫৫ কোটি টাকা, ব্যাংকের অনাদায়ী হয়েছে ৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মেসার্স ইউকে-বাংলা ট্রেডিং কোম্পানিকে গুলশান শাখা থেকে ঋণ দেয়া হয় ২০ কোটি টাকা, ব্যাংকের অনাদায়ী হয়েছে ২৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। মেসার্স ভেসাভী ফ্যাশনকে ঋণ দেয়া হয়েছে ১১ কোটি টাকা, তাদের অনাদায়ীর পরিমাণ হচ্ছে ১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। মেসার্স ওয়াটার হেভেন কর্পোরেশনকে ঋণ দেয়া হয় ২৪ কোটি টাকা, তাদের অনাদায়ী হয়েছে ২৮ কোটি ২২ লাখ টাকা। মোট ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৫টি শিল্প গ্র“পের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭২১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি ঋণের প্রায় সবক্ষেত্রে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ঋণ মঞ্জুরির সীমার বেশি। শান্তিনগর, কারওয়ান বাজার এবং দিলকুশা শাখার ঋণ মঞ্জুরির সীমা এবং অনাদায়ী ঋণের পরিমাণের ক্ষেত্রে একই চিত্র দেখা গেছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সালে ৯টি একক ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ হিসাবে ৪৫৬ কোটি টাকা ও ২০১০ সালে ৮টি একক প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ৪৯৫ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ১২টি একক ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ অর্থাৎ ৮৮১ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ২৩টি একক ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ২২ দশমিক ৮৬ শতাংশ অর্থাৎ ২৩০৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। বিশেষায়িত এই ব্যাংকে ২০০৯ সালে ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫৬ কোটি টাকা, কিন্তু ২০১৩ সালে এটি দাঁড়িয়েছে ২৩০৫ কোটি টাকা। এটি ২০০৯ সালের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণ প্রস্তাব গ্রহণের আগে গ্রাহকের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, সামর্থ্য ও ব্যবসারস্থল পরিদর্শন না করে ঋণপ্রস্তাব পেশ করা হয়। অধিকাংশ ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে গ্রাহকের সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়নি। ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্ত পালন না করেই অর্থ ছাড়ের ঘটনা ঘটেছে। প্রয়োজনীয় জামানত ব্যতিরেকে ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুমোদনের পর অর্থছাড়ের আগে নির্দেশিত জামানত গ্রহণ না করে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment