বৈষম্য বিলোপ আইনের খসড়া দ্রুত চূড়ান্ত হওয়া প্রয়োজন। আইন করে দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ভালোবাসতে বাধ্য করা যাবে না, কিন্তু ঘৃণা করা থেকে নিরস্ত করা যাবে। গতকাল বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ‘দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ: বৈষম্য বিলোপ আইন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক ছিল প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ দলিত পরিষদ, বেসরকারি সংস্
থা পরিত্রাণ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন উদ্যোগী হয়ে আইনটির খসড়া তৈরি করেছে। এটি এখন আইন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বৈঠকে বৈষম্য বিলোপ আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের মতো বৈষম্য বিলোপ সেল এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিধান রাখার প্রস্তাব করেছেন। দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তাঁদের ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণ লাল বলেন, ‘আমাদের অবস্থা ৩২টি দাঁতের ভেতর একটা জিব যেভাবে থাকে সে রকম। বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার হলেও আমরা কখনো কিছু বলতে পারি না।’ বৈঠকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মনুষ্যত্বের মর্যাদা নিশ্চিতের জন্য। সংবিধানে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য লুকিয়ে আছে।’ তিনি বৈষম্যমূলক আচরণের পাশাপাশি বৈষম্যমূলক কথাবার্তাকেও শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, যাঁরা বৈষম্য বিলোপ আইন প্রয়োগে শৈথিল্য, কৌটিল্য বা উদাসীনতা দেখাবেন, তিনিও যেন একই অপরাধে অভিযুক্ত হন, আইনে সে সুযোগ রাখা দরকার। আইন কমিশনের সদস্য এম শাহ আলম বলেন, আইন পাস হওয়ার আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পাশে গণমাধ্যমকে দাঁড়াতে হবে। বৈঠকের শুরুতে দলিতদের মানবাধিকার পরিস্থিতি উপস্থাপন করেন পরিত্রাণের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ দলিত পরিষদের উপদেষ্টা মিলন দাস। তিনি বলেন, দলিতরা শিক্ষা-দীক্ষায় যতই এগিয়ে যাক, তাদের যোগ্যতাকে ছাপিয়ে যায় দলিত পরিচয়টি। এসব জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের অবস্থা আরও বেশি নাজুক। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আইনটির প্রস্তাবে দলিতরা যে ঐতিহাসিকভাবে নিগৃহীত ও বঞ্চিত, সে সম্পর্কে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। আইনের পাশাপাশি দলিতদের প্রতি ‘পক্ষপাতমূলক’ একটি নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেছেন, প্রস্তাবিত আইনে দলিতদের কথা যেভাবে এসেছে, বঞ্চিত আর সব জনগোষ্ঠীর কথা সেভাবে আসেনি। সবাইকে এ আইনের আওতায় আনা যেতে পারে বলে তিনি মত দেন। চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা করে দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি। হেকস, বাংলাদেশের এ দেশীয় পরিচালক শামিমা আখতার বলেন, দলিত জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা যখন উচ্চশিক্ষায় আসছে, তখন তারা তাদের পরিচয় গোপন করছে। বৈষম্যের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় তারা সাহস হারিয়ে ফেলেছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিইবের নির্বাহী পরিচালক মেঘনাগুহ ঠাকুরতা বলেছেন, আইন শুধু পাস করলে চলবে না। এর কার্যকর প্রয়োগ দরকার। বৈষম্যলোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আদতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই বৈষম্যের শুরু বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ দলিত পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অশোক দাস। তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবনের শুরু, সেখান থেকে বৈষম্যেরও শুরু। সুষমা রানী দাস জানান, তাঁর এক মেয়ে নার্স, এক ছেলে চিকিৎসক৷ তবু তিনি ও তাঁর পরিবার নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হওয়ার ‘দোষে’ প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নির্মল চন্দ্র দাস। পরিত্রাণের কর্মী শান্তি মণ্ডল বলেন, স্কুলের শৌচাগার তাঁদের শিশুদের দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়। সাতক্ষীরা তালা উপজেলার দলিত প্রতিনিধি রতন দাস বলেন, তাঁর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে। তিনি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু ৪৬টি স্কুলে পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পাননি। সুহৃদ সরকারসহ আরও কয়েকজন দলিত প্রতিনিধি আইনটির কতটা প্রয়োগ হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। বৈঠকে আরও বক্তৃতা করেন উন্নয়নকর্মী সেরজো টারগা।
No comments:
Post a Comment