Wednesday, July 23, 2014

এইচ আর গ্রুপের হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি:যুগান্তর

চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২২টি ব্যাংকের শাখা থেকে এইচ আর গ্রুপ অভিনব কৌশলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। ব্যাংকগুলোও নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে গ্রুপকে বেআইনি ঋণ দিয়েছে। গ্রুপটিও ভুয়া বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে। গ্রুপের যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে সেগুলোও বর্তমানে বন্ধ। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির ঘোষণা দিয়েছে বাস্তবে ওইসব বেশির ভাগের অস্তিত্ব নেই। এভাবে বন্ধ প্রতিষ্ঠানের না
মে ঋণ, ভুয়া প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির নামে হাজার কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। এসব কাজে সহায়তা করেছে ব্যাংকগুলোর কিছু কর্মকর্তা। ব্যাংকের শাখা পর্যায় থেকে প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।গ্রুপের খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে বেআইনিভাবে নতুন ঋণ দেয়ার নজিরও রয়েছে। ব্যাংকের দুর্নাম ঘুচাতে খেলাপি হওয়ার এক বছরের মধ্যে নজিরবিহীনভাবে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাংকগুলোতে অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, এইচ আর গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে ২২টি ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাখাগুলোতে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ৬টি ব্যাংকে তদন্ত হয়েছে। বাকি ১৬টি ব্যাংকে তদন্ত চলছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে জামানত নেই বললেই চলে। কিছু ঋণের বিপরীতে রয়েছে নামমাত্র জামানত। অনেক ক্ষেত্রের জামানত ভুয়া। প্রায় সব ঋণই খেলাপি। ফলে ওইসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা নেই। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এইচ আর ত্মপের মালিক হারুনুর রশিদ বলেন, ব্যবসায় মন্দার কারণে তিনি আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। এটা সাময়িক। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তিনি বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবেন বলে জানান। তবে কিভাবে তিনি এর সমাধান করবেন সে বিষয়ে কিছু বলেননি। তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মন্দার কারণে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে তার কোনো হাত ছিল না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। এ বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি। যেসব ব্যাংকে জালিয়াতি : এখন পর্যন্ত ৬টি ব্যাংকে ৫৬২ কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ১৬টি ব্যাংকের আরও ৪০০ কোটি টাকার বেশি জালিয়াতি হয়েছে। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি পূর্বপাড় শাখায় ১৬০ কোটি, জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা ভবন শাখায় ৭৫ কোটি, ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ১২০ কোটি, আল আরাফাহ ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ৮৪ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের পাহাড়তলী শাখায় ৭০ কোটি, হালিশহর শাখায় ২৮ কোটি এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২৫ কোটি টাকার জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকেও জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। ইতিমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থা : জালিয়াতির দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। ছয়টি ব্যাংকই এ ব্যাপারে সময় চেয়েছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংককে ওই ঋণের বিপরীতে ১১৭ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংককে ৭০ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ঋণ খেলাপি হওয়ায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পরিচালকের পদ ছাড়তে হয়েছে হারুনুর রশিদকে। ব্যাংকগুলোও এখন ত্মপকে নতুন ঋণ দিচ্ছে না। আগের যেসব ঋণ রয়েছে সেগুলোর বিপরীতে জামানত নিয়ে ঋণকে ঝুঁকিমুক্ত করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু গ্রুপের মালিক হারুনুর রশিদকে তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জালিয়াতির ধরন : ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ঋণের স্থিতি ১২০ কোটি টাকা। ঋণ শোধের জন্য কিছু টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে পূবালী ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে। কিন্তু ওই দুই ব্যাংকে হারুনুর রশিদের কোনো ঋণ হিসাব নেই। ওই সব টাকা স্থানান্তর করে হারুনুর রশিদ তার নিজের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তুলে নিয়েছেন। পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও নীতিমালা ভঙ্গ করা হয়েছে। গ্রাহক যে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনেছে তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা ভবন শাখায় গ্রুপের ঋণের স্থিতি ৭৫ কোটি টাকা। জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রথমে গ্রুপকে বৈদেশিক এলসি খুলে পণ্য আমদানির জন্য ঋণ দেয়। পণ্য বিক্রি করে দেনা শোধ না করায় ব্যাংক ফোর্স লোন সৃষ্টি করে বিদেশী ব্যাংকের দায় শোধ করে। ওই টাকা শোধ না করায় তা খেলাপিতে পরিণত হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি করা হয়েছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। খেলাপি ঋণের দুর্নাম ঘুচাতে ঋণটি খেলাপি হওয়ার এক বছরের মধ্যেই অবলোপন করা হয়েছে। গ্রুপের সাউথইস্ট ব্যাংকের পাহাড়তলী শাখায় ৭০ কোটি এবং হালিশহর শাখায় ২৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে। এই টাকা আদায়ে ব্যাংক মামলা করেছে অর্থঋণ আদালতে। টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার অনুযায়ী জমা দেয়া চেক ডিজঅনার হওয়ায়ও ব্যাংক মামলা করেছে। শাহজালাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে জামানত ছাড়াই গ্রুপের রুবাইয়া ভেজিটেবল ওয়েলকে ২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। ট্রাস্ট রিসিপ্ট বা টিআর (পণ্য আমদানির জন্য সহজ শর্তের ঋণ) আওতায় দেয়া ঋণের মাধ্যামে গ্রাহকের পণ্য আনার কথা। যা থাকবে ব্যাংকের জিম্মায়। কিন্তু গ্রাহক পণ্য আমদানি করে তা গুদাম থেকে বিক্রি করে দিয়ে ব্যাংকের টাকা শোধ করেনি। ফলে পুরো ঋণটি খেলাপি হয়ে যায়। কিন্তু ব্যাংক খেলাপি হিসাবে না দেখিয়ে নতুন ঋণ দিয়েছে। এভাবে ঋণ খেলাপি হওয়ার পর তা তিন দফা নবায়ন করেছে। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন জানান, সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বকেয়ার জন্য গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। তিনি ঋণ নিয়েছিলেন ২১ কোটি, সুদসহ পরিশোধ করেছেন ২৩ কোটি টাকা। বাকি টাকা পরিশোধে প্রতিশ্র“তি দিয়ে যাচ্ছেন। তাকে কোনোভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তার স্টাফরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আল আরাফাহ ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা গ্রুপের এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস ও ন্যাশনাল আইরন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ঋণ দিয়েছে সাড়ে ৮৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। শর্ত অনুযায়ী ঋণ শোধ করেনি। তারপরও খেলাপি গ্রাহককে নতুন ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি পূর্র্বপাড় শাখা থেকে গ্রুপের রুবাইয়া ভেজিটেবল ওয়েল ও চিটাগাং ইস্পাতকে ঋণ দিয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। ঋণ শোধে যেসব চেক দিয়েছে সেগুলো ডিজঅনার হওয়ায় ব্যাংক মামলা করেছে। ইতিমধ্যে ১৪৮ কোটি টাকা অবলোপন করেছে। এ টাকা আদায়ে মামলা চলছে। ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আমম শাহজাহান বলেন,গ্রুপের ১৫২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে পুরনো জাহাজ ক্রয়ের জন্য নেয়া ১১২ কোটি টাকা ছিল মূল ঋণ। টাকা আদায়ে ব্যাংক তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে দুটি এবং পাঁচটি চেক ডিজঅনারের মামলা করেছে। অর্থঋণ মামলার বিরুদ্ধে তিনি রিট করে স্থগিতাদেশ নেন। ব্যাংক পরে একটির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জানান, মামলার পাশাপাশি ব্যাংকের টাকা আদায়ে আলাপ-আলোচনাও চলছে। তাদের প্রচুর জমি, পাওয়ার প্লান্ট আছে। আরও ২০০ কোটি টাকার জমি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নবায়নের প্রক্রিয়াও চলছে। ব্যাংক এশিয়ার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রোসাংগির জানান, ওয়ান-ইলেভেন সময়ে ব্যবসায় মার খাওয়ার পর গ্রুপের সংকট শুরু। পরবর্তীতে ওভার ট্রেড করতে গিয়ে অবস্থা আরও খারাপ হয়। একটি পাওয়ার প্লান্ট করেছেন তিনি। এতে ৩০০ কোটি টাকা নিজস্ব বিনিয়োগ করেছেন। সেখানে বিপুল টাকা আটকে যাওয়ায় অন্য ব্যবসায় সংকট তৈরি হয়। ব্যাংকিং খাতে তিনি ভালো গ্রাহক হিসেবে পরিচিত। তার প্রচুর ভূসম্পত্তি রয়েছে। যা দিয়ে দায়দেনা শোধ করা সম্ভব। তার মতে, গত ২৫-৩০ বছর ধরে তিনি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছেন। গত বছর ভোজ্যতেল এবং পুরনো জাহাজ ব্যবসায় মোটা অংকের লোকসান দিয়ে বেকায়দায় পড়েন। তিনি প্রতি টন ভোজ্যতেল কেনেন ১ হাজার ৩০০ ডলারে, দেশে আসার পর দর কমে ৬৫০ ডলারে দাঁড়ায়। একইভাবে পুরনো জাহাজ প্রতিটন কেনেন ৫৫০ ডলারে, তিন মাস পর দেশে পৌঁছলে দর নেমে আসে ৩০০ ডলারে। সূত্র জানায়, ঋণের টাকায় চট্টগ্রামে অনেক জমি কিনেছেন। জমির দাম কমে যাওয়া ও নানা জটিলতায় বর্তমানে লোকসান দিয়েও বিক্রি করতে পারছেন না। খেলাপির কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পথ আগেই বন্ধ। ব্যবসাও এখন আর সচল নয়। ফলে ব্যবসা থেকেও টাকা আসছে না। এই যখন অবস্থা তখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও ঋণ নেন। সেগুলো শোধ করতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ জানান, এইচ আর গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রচুর দায়দেনা ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়েও রয়েছে বিপুল অংকের ঋণ। গত বছর রমজান মাসেও এমএ লতিফ এমপির নেতৃত্বে এ ধরনের বেশ কয়েকটি সালিশি বৈঠক হয়েছে।  

No comments:

Post a Comment