Friday, July 18, 2014

রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সংকট:যুগান্তর

অব্যবস্থাপনা, পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণে ত্র“টি, মাত্রাধিক অবৈধ সংযোগ আর সরবাহে ভারসাম্যহীনতার পরিণতিতে রাজধানীজুড়ে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। মিরপুরের ২/১ দারুস সালামের বাসিন্দা আবদুল লতিফ জানান, প্রথম রোজা থেকে তার বাসায় গ্যাস নেই। আগে টিমটিম করে চুলা জ্বলত। কিন্তু প্রথম রোজা থেকে পুরোপুরি পাইপলাইন থেকে গ্যাস উধাও হয়ে যায়। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তার চুলায় গ্যাস আসেনি। রমজান মাসজুড়ে তাদের হোট
েলের খাবার ও আÍীয়-স্বজনদের বাসা থেকে রান্না করে এনে রোজা রাখতে হচ্ছে। স্থানীয় তিতাস কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার এ সমস্যার কথা জানালেও তারা কর্ণপাত করেনি। এ পর্যন্ত নানাভাবে মিস্ত্রি এনে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করেও সংকট সমাধান করতে পারেননি। আবদুল লতিফ বলেন, তার বিল্ডিংয়ে ৩-৪ জন ভাড়াটিয়া আছেন। গ্যাসের এই সংকটের কারণে আগামী মাস থেকে সবাই বাসা ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দিয়েছে। একদিকে গ্যাস সংকট, অন্যদিকে ভাড়াটিয়াদের দুর্দশা- দুই মিলে তিনি এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন। ঠাণ্ডা-বাসি খাবার খেয়ে তিনি নিজে এবং পরিবারের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সংকট সমাধানে অসহায় আবদুল লতিফ অবিলম্বে তিতাস কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। শুধু আবদুল লতিফই নন, দারুস সালামসহ মিরপুরের কল্যাণপুর, পানির ট্যাঙ্ক, কাজীপাড়া, শ্যামলী, পীরেরবাগ, পল্লবীর অনেক বাসিন্দাই গ্যাস সংকটে নাকাল অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে ইফতার তৈরি এবং সেহরি খাওয়ার আগে এসব এলাকায় চুলা জ্বলছে টিমটিম করে। এ সময় গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকছে। অনেক এলাকায় চুলা জ্বলছেই না। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, সেহরির সময়ও ঠাণ্ডা ও বাসি খাবার খেয়ে রোজা রাখতে হচ্ছে তাদের। খোদ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গ্যাস সঙ্কট নিয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছে নানা অভিযোগ। এসব অভিযোগ সামাল দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে পারছেন না তারা। অভিযোগ রয়েছে, তিতাসের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদার মোটা অংকের টাকা নিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকা, বস্তি ও বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানীর ভবনে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। গাজীপুর, ডেমরা, সাভার, নারায়ণগঞ্জের অনেক এলাকায় আবাসিক সংযোগের নামে অবৈধভাবে শিল্প সংযোগ দিচ্ছে। এ কারণে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও হঠাৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। তাছাড়া দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রও হচ্ছে গ্যাস নিয়ে। সরেজমিন মিরপুর ও আরও কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে দিন দিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে এসব এলাকার বাসিন্দারা। রোজার আগে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্বস্ত করছিল নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের। কিন্তু প্রথম রোজা থেকেই এই সঙ্কট তীব্র হয়ে দেখা দেয়। রাতে গ্যাসের যে ক্ষীণ চাপ আসে তা দিয়ে এক ঘণ্টার রান্নার কাজ চার ঘণ্টায়ও শেষ করা যায় না। রাজধানীতে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে আবাসিকসহ শিল্পকারখানায় কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া অনেক এলাকার গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন পুরনো ও সরু হয়ে পড়ায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। এর মধ্যে মিরপুর এলাকা অন্যতম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে মিরপুর এলাকায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগ সবচেয়ে বেশি। দুই ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন দিয়ে বৈধভাবে আগে গ্যাস সংযোগ নিয়েছিলেন ১০০ গ্রাহক। এখন ওই পাইপের সঙ্গে অবৈধভাবে আরও ৫শ’ থেকে ১ হাজার গ্রাহক গ্যাস সংযোগ নিয়েছে। এর ফলে একই ব্যাসের পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। এভাবেই গ্যাস সঙ্কট বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। আর দারুস সালাম এলাকার কিছু কিছু বাড়ির গ্যাস পাইপলাইন অনেক নিচে দেবে গেছে। এ কারণে গ্যাস থাকলেও পাইপে তা প্রবেশ করছে না। মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকার বাসিন্দা আজাদ জানান, সকালে তাদের এলাকার পাইপলাইনে কোনো গ্যাস থাকে না। এ অবস্থা সারা দিনই চলে। বিকালের দিকে পাইপলাইনে সামান্য গ্যাস থাকে। তবে তা দিয়ে পানি পর্যন্ত ফুটানো যায় না। মিরপুর সাংবাদিক আবাসিক এলাকার গৃহিণী আজমীরী বেগম বলেন, সবকিছু আয়োজন করে বিকালে রান্নাঘরে যাই। কিন্তু ইফতারের আয়োজন শেষ করতে রাত ১০টা বেজে যায়। সাংবাদিক আবাসিক এলাকার অপর এক গ্রাহক জানান, সাংবাদিক আবাসিক এলাকার গ্যাস সঙ্কট চরম আকারে পৌঁছানোর কারণে ভাড়াটিয়ারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে তিতাসের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মীর মশিউর রহমান জানান, অবৈধ গ্রাহকদের চিহ্নিত করতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তিতাসের অভিযানে অনেক গ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুরনো লাইন ঠিক করতে তিতাসের প্রকল্প রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুরনো লাইন ঠিক করা হচ্ছে। এছাড়া বাড়তি বিদ্যুৎ সংগ্রহ করতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। এ কারণেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বর্ধিত হারে গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে গ্যাস সরবরাহ কম করতে হচ্ছে। সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে সরবরাহ লাইন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতার পাইপলাইন থেকে কয়েকগুণ বেশি অবৈধ সংযোগ নেয়ায় এ অবস্থা। আবার অনেক এলাকার গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন পুরনো ও সরু হয়ে পড়ায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। এছাড়া সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে অধিক গুরুত্ব দেয়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করছে। তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন রাজধানী ও আশপাশের আবাসিক এলাকায় গ্যাসের চাহিদা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে ১৩৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি প্রায় ৪০ থেকে ৪২ মিলিয়ন ঘনফুট। সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ২০০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন রয়েছে। এই পাইপলাইন থেকে প্রায় ২ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেয়া হয়েছে। ফলে বৈধ গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জানা গেছে, রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, মুগদা, মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি, মুসলিম বাজার, কাজীপাড়া, পীরেরবাগ, শেওড়াপাড়া, আনসার ক্যাম্প, রূপনগর, তুরাগ এলাকার কামারপাড়া, ভাটুলিয়া, দক্ষিণখানের আশকোনা, পুরান ঢাকার টিকাটুলি, গোপীবাগ, মানিকনগর, সায়েদাবাদ, স্বামীবাগ, কে এম দাস লেন, ধলপুর, ধোলাইরপাড়, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, নবীনগর, মুরাদপুর, পাটেরবাগ, হাজী খোরশেদ আলী রোড, কুতুবখালী, জিয়া সরণি, কাজলা, ভাঙ্গা প্রেস, টিপু সুলতান রোড, নবাবপুর রোড, নারিন্দা, ফুলবাড়িয়া, বিবির বাগিচা, করাতিটোলা, মৈশুন্ডি, বনগ্রামসহ রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া, আটি, কালিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস সঙ্কট চলছে। যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, গ্যাস সঙ্কট ক্রমেই বাড়ছে। রমজানেও তারা এ সঙ্কট থেকে রেহাই পাননি। সকালে থাকে তো দুপুরে নেই। আবার সন্ধ্যায় আছে তো রাতে নেই। গ্যাস কখন থাকবে আর থাকবে না- এই হিসাব করে তো আর চলা যায় না। মিরপুরের বাসিন্দা আহসান হাবিব বলেন, সকাল ১০টার পর থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। রমজানের সময় দুপুরের পর রান্না করতে হয়। তাহলে কিভাবে চলবে? এই এলাকার আরেক বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন বলেন, অনেক সময় সেহরির সময়ও গ্যাস থাকে না। ফলে আগের রাতের ঠাণ্ডা ও বাসি খাবারই সেহরির সময় খেতে হয়। গত ৫ বছরে ৫১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে বাড়তি যোগ হয়েছে। সূত্র জানায়, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া ৫১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে কমপক্ষে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চলে যাচ্ছে অবৈধ গ্রাহকদের কাছে।  

No comments:

Post a Comment