Tuesday, August 12, 2014

বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা পাচ্ছে সংসদ:কালের কন্ঠ

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের এখতিয়ার সংসদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধনীর খসড়া বিল প্রস্তুত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও সংসদের হাতে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব বিধান রেখে সংশোধনী বিলের খসড়া তৈরি করা হলেও তাতে শেষ মুহূর্তে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমপি পদ লাভজনক নয় বিষয়টিও। বর্তমানে কোন কোন পদ লাভজনক নয়, সে
ই তালিকায় এমপিরা নেই। এ ছাড়া সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলের বিষয়টিতেও খানিকটা পরিবর্তন আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধনীর খসড়া বিলের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। আইনমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘ষষ্ঠদশ সংশোধনীর বিষয়ে আমাদের সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে।’ বৈঠক শেষে মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র সদস্য কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানান। সংবিধান সংশোধন নিয়ে এক মাস ধরে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে আইন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মধ্যে। গত সপ্তাহে তা চূড়ান্ত করা হয়। ষষ্ঠদশ সংশোধনীর জন্য আইন মন্ত্রণালয় শিগগিরই বিলটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করবে। নীতিগত অনুমোদনের পরই খসড়া বিলটি সংসদীয় কমিটিতে যাবে। সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে আবার মতামত দেওয়ার সুযোগ পাবে। সংসদের আগামী অধিবেশনেই এ-সংক্রান্ত সংশোধনী আসছে বলে একজন সিনিয়র মন্ত্রী জানিয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনীর জন্য প্রস্তুত খসড়ায় সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে আটটি উপ-অনুচ্ছেদ রয়েছে। খসড়ায় ৯৬ অনুচ্ছেদে উপ-অনুচ্ছেদ থাকবে মাত্র চারটি। এর মধ্যে বিচারকদের অপসারণ-সংক্রান্ত ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে ৯৬(২) অনুচ্ছেদে। আর বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণের পদ্ধতি আইন দিয়ে নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে। ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।’ ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।’ এ দুটি বিধান ছাড়া ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭ বছর এবং রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁদের পদত্যাগের বিধান রয়েছে। বর্তমানে বিচারকদের কারো কাছে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা নেই। সংসদ তথা জনগণের কাছে বিচারকদের দায়বদ্ধ করার জন্য ষষ্ঠদশ সংশোধনী আনা হচ্ছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারকদের দক্ষতা ও আচরণ তদন্ত করে যদি কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবেই রাষ্ট্রপতি বিচারককে অভিশংসন করতে পারেন। ১৯৭৮ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের এই বিধান সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়। এই বিধানটি বিচার বিভাগকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিল। ইচ্ছা করলেই সরকার যখন তখন কোনো বিচারককে অপসারণ করতে পারত না। এর আগে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা ছিল জাতীয় সংসদের হাতে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিও সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। তাঁদের নৈতিকস্খলন হলে বা অন্য কোনো কারণে সংসদ তাঁদের ইমপিচ করতে পারে। কিন্তু বিচারকদের ক্ষেত্রে সংসদ তা করতে পারে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিচার বিভাগের নানা ধরনের কাজে বিব্রত হয়েছে সরকার। এ জন্যই তাঁদের সংসদ তথা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর আগে সংসদীয় কমিটি এই বিধান ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে একই সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সময়ই এটা অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল তা থেকে সরে আসে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সামরিক বিধি দ্বারা সংবিধানের দাড়ি-কমাও পরিবর্তন করা যায় না। কাজেই সামরিক সরকারের ঘোষণাপত্র মারফত নতুন করে প্রতিস্থাপিত ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান একেবারেই অবৈধ ছিল। যদিও তা ১৯৭৮ সালের পর পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে বৈধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কাজেই সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ যদি ’৭২ সালের সংবিধানে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা বেআইনি হবে না। ভারতসহ বহু দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল আছে। ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স ১৬৯৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ১৭৮৭ সালে এবং ভারতের লোকসভা ১৯৫০ সালে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থা আরো দেশে চালু আছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোন প্রতিষ্ঠান সার্বভৌম তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সার্বভৌম বলে অভিমত দেন। যেহেতু জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা কাজ করেন, তাই সংসদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে জনগণের সার্বভৌমত্বকেই মেনে নেওয়া হয়।   ষষ্ঠদশ সংশোধন বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে সংসদে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ এই তিনটি অঙ্গের জবাবদিহিতা সংসদের কাছে ন্যস্ত ছিল। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের ব্যক্তিগত এবং যৌথ দায়িত্বশীলতা সংসদের কাছে রয়েছে। আস্থা ভোটে হেরে গেলে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। অর্থাৎ জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র উপায়। সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের অবশ্যই সংসদের কাছে জবাবদিহিতা রয়েছে, যা প্রজাতন্ত্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদেরও সংসদের কাছে জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়নি, কারণ সংসদসদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। অতএব সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদেরও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদের কাছে জবাবদিহির আইনগত ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ জনগণই সব ক্ষমতার উৎস এবং ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের মালিক। তবে এ নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে, সংবিধানে এ ধরনের পরিবর্তন করতে হলে আবার সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এই নির্বাচন নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। তাই এই সংসদের সংবিধান পরিবর্তন করা উচিত না। একজন ওএসডি অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, এ সরকার বিভিন্নভাবে ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে সব কিছু নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য পূরণ হবে। কারণ উচ্চ আদালতে বিচারকদের অপসারণ করার ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার অর্থই হলো বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারের পক্ষে রায় না গেলেই ওই বিচারক রোষানলে পড়তে পারেন। এই অবস্থা হলে আইন অনুসরণ না করে সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হবে নির্দেশনার জন্য। আর সেটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।

No comments:

Post a Comment