উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের (অপসারণ) মতা সংসদকে দেয়ার প্রস্তাব বিচার বিভাগকে নগ্নভাবে দলীয়করণেরই প্রচেষ্টা। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। আদালতের রায় বা আদেশ সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাবে। সংবিধানে বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া আছে। কিন্তু অভিশংসনের ভার সংসদকে দিয়ে বিচারকদের বিচার যদি সংসদ সদস্যদের হাতে দেয়া হয় তাহলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বলে মন
ে করেন আইনবিদরা। তাদের মতে এটা একটি অশুভ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন না। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিচার বিভাগ ইতোমধ্যেই দলীয়করণের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। তদুপরী বিচার বিভাগকে একটি অনির্বাচিত সংসদের আওতায় আনার অশুভ প্রচেষ্টায় সরকার সংবিধান পরিবর্তন করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা হাতে নিতে চাচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ বিচার বিভাগকে নগ্নভাবে দলীয়করণেরই প্রচেষ্টা বলে আমি মনে করি। সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক শম রেজাউল করিম বলেন, আমি মনে করি বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে দেয়া ঠিক হবে না। প্রয়োজনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে চলে গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না। আদালতের রায় বা আদেশ সরকারের ইচ্ছায় করতে হবে। এটা করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তিনি বলেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের পঞ্চম সংশোধনীর রায়েও এটি বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা আরো বলেন, বিচারক নিয়োগ স্বচ্ছতার সাথে হতে হবে। কিন্তু বিচারক নিয়োগ আর অভিশংসন এক জিনিস নয়। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দণি আফ্রিকাসহ যেসব দেশে সংসদের হাতে অভিশংসনের ব্যবস্থা আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন করার অনুচ্ছেদ (আর্টিকেল) ছিল। কিন্তু সামরিক সরকার মতায় এসে তা বদলে ফেলে। এর পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করে। এখন উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের (অপসারণ) মতা আবারো জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ভারতসহ যেসব দেশে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা দেয়া আছে, সেসব দেশের সংবিধান খতিয়ে দেখাসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু করেছে আইন মন্ত্রণালয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের কাছে ছিল। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এ মতা বিচার বিভাগের কাছে ন্যস্ত হয়। এতে বলা হয়, বিচারপতিদের অভিশংসনে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে পারবেন। এ ছাড়া বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন সে রায়েও এই ক্ষমতা বিচার বিভাগের কাছে রাখার পক্ষে অভিমত রয়েছে। জানা গেছে, সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন করার মতা জাতীয় সংসদকে ফিরিয়ে দিতে ’৭২ সালের সংবিধান অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনের (অপসারণ) মতা সংসদকে দেয়ার প্রস্তাব চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো: ইউনুস আলী আকন্দ রিট আবেদনটি করেন। এতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন সংক্রান্ত প্রস্তাব কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে রুল চাওয়া হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান তিনি। পাশাপাশি এই প্রস্তাব সংক্রান্ত সব কার্যক্রমে স্থিতাবস্থা ও স্থগিতাদেশ চেয়েছেন রিটকারী। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও আইন সচিবকে রিটে বিবাদি করা হয়েছে। রিট দায়েরের পর ইউনুস আলী আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে থাকলেও পরে ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়। বিচারপতিদের অপসারণের মতা পরে দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত হয়। উচ্চ আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও এ বিষয়টি বহাল থাকে। ২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের মতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জোরালো হয়। এর আগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ও এ নিয়ে আলোচনা হয়। সে সময় ৯৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন করা না হলেও আইন কমিশন গত ২৬ জুন সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে একটি সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়। গত ১৭ জুলাই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সংসদের কাছে সব বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে সার্বভৌম সংসদ হয় না। সংসদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতের জন্যই সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন অনিবার্য।
No comments:
Post a Comment