ম্যানেজ মাস্টার ওসি সালাউদ্দিন সবকিছুই ম্যানেজ করে ফেলেছেন। ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ এখন তার ওপর তুষ্ট। থানায় পিটিয়ে মানুষ হত্যার পরেও সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এবারো তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে বহাল তবিয়তে মিরপুর থানার ওসির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, কয়েকজন বড় কর্মকর্তার আশীর্বাদ থাকায় এর চেয়ে বড় অন্যায় করলেও ওসি সালাউদ্দিনের কিছুই হবে না। এর আগে দুর্নীতি দমন কমি
শনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেও তখনো সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেন এই সালাউদ্দিন। তিনি বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের ওপর নির্যাতন করেও বহাল রয়েছেন। বরং সাংবাদিক নির্যাতন করে তার কর্তাগিরি আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। গত ১২ জুলাই রাজধানীর শঙ্করের বাসা থেকে ধরে নিয়ে মিরপুর থানাহাজতে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সুজন নামে এক ব্যবসায়ীকে। এ ঘটনায় মিরপুর থানার এসআই জাহিদকে গ্রেফতার করার পরে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তবে ওই স্বীকারোক্তিতে বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে ওসি সালাউদ্দিনকে। সুজনের স্ত্রী মমতাজ সুলতানা লুচি অভিযোগ করেছেন, তার স্বামী ঝুট কাপড়ের ব্যবসা করতেন এবং পুলিশ প্রতি মাসে তার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিতো। সর্বশেষ পুলিশ সুজনের কাছে মাসে এক লাখ টাকা বখরা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। পুলিশের ভয়ে সুজন পরিবার-পরিজন নিয়ে মিরপুর ছেড়ে ধানমন্ডির শঙ্করে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে পুলিশ ১২ জুলাই রাত ১২টায় সুজনকে ধরে আনে। বাসার ভেতরেই পুলিশ সুজন এবং তার স্ত্রী লুচিকে বেদম প্রহার করে। এ সময় তাদের পাঁচ বছরের শিশুসন্তান উপস্থিত ছিল। শিশুটি পুলিশের পা জড়িয়ে ধরলে পুলিশ তাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। এতে শিশুটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওই অবস্থায় পুলিশ সুজনের সাথে তার স্ত্রী-সন্তানকেও থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সুজনকে এক কক্ষে আটকে নির্মম নির্যাতন করা হয়। সেখানেই মারা যান ব্যবসায়ী সুজন। এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ওসি সালাউদ্দিন থানাহাজতে সুজনের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে দেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সালাউদ্দিনের নির্দেশেই ব্যবসায়ী সুজনকে এসআই জাহিদ ধরে নিয়ে যান। সকালে ওসির নির্দেশেই সুজনের স্ত্রী এবং শিশুসন্তানকে থানা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা বলেন, সালাউদ্দিন কোনোভাবেই এই হত্যার দায় এড়াতে পারবেন না। মিরপুর জোনের ডিসির কাছেও পরিবারের পক্ষ থেকে সুজনকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ডিসিও বিষয়টি এড়িয়ে যান। ২০১২ সালের ২৯ মে আদালতপাড়ায় বিচারপ্রার্থী এক তরুণী মোটরসাইকেলে তার বাবার সাথে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যাওয়ার সময় পুলিশের সাথে ওই তরুণীর কথা কাটাকাটি হয়। এরপর পুলিশ তাকে টেনেহিঁচড়ে আদালতপাড়ায় পুলিশ কাবে নিয়ে শ্লীলতাহানি করে। এ ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক ও আইনজীবী। দিনভর ওই তরুণীকে কোতোয়ালি থানায় আটকে রাখা হয়। পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন কোতোয়ালি জোনের পুলিশের তৎকালীন এসি রাজিব আল মাসুদ ও বিতর্কিত এই ওসি সালাউদ্দিন। পরে খবর পেয়ে সন্ধ্যায় আইন-সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল নিজ হেফাজতে তরুণীকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। এ ঘটনায় তীব্র সমালোচনার একপর্যায়ে ওই দিন সন্ধ্যায় এস আই নূরুজ্জামান সরকার ও আমির আফজাল বিপ্লবকে প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিন কোতোয়ালি জোনের এসি রাজিব আল মাসুদ ও ওসি সালাউদ্দিনকে কোজড করা হয়। ওসি সালাউদ্দিনকে কোতোয়ালি থানা থেকে কোজড করা হলে ওই এলাকার অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল ওসির চাঁদাবাজিতে তারা অতিষ্ঠ ছিলেন। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে সালাউদ্দিনকে মিরপুর মডেল থানার ওসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর থেকে শুরু হয় সালাউদ্দিনের আরো নির্মম কর্মকাণ্ড। অভিযোগ রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আযাহারুল ইসলামকে এই থানায় আটকে রেখে হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়। হাত-পায়ের নখ তুলে নেয় পুলিশ। এরপর দুই লাখ টাকা দাবি করে। পুলিশি নির্যাতনের শিকার আযাহার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। গত ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার পরে তার কোনো খোঁজ ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে ১৯ সেপ্টেম্বর আব্দুল্লাহ পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ওই রাতেই একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে পরিবারের সদস্যদের ফোন করে জানানো হয় আযাহার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পান আযাহার ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর বেডে ভর্তি। পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে জানতে পারেন আযাহারকে এসআই রফিক আটক করেছেন। ডিউটি অফিসার তাদের এসআই রফিকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। তারা এসআই রফিকের সাথে যোগাযোগ করলে রফিক তাদের থানার ওসি সালাউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান। অভিযোগ পাওয়া গেছে সালাউদ্দিন ওই পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। গত বছরের ১৭ মার্চ মিরপুরে মাহবুব বাবলু নামে এক যুবকের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। তিনি এখন পঙ্গু। গত বছরের ১০ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে রাজধানীর মিরপুর থানার কাজীপাড়া এলাকা থেকে মিল্টন ও শিপন নামে দুই যুবদল কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। থানায় নেয়ার আধাঘণ্টা পরে তাদের আহত অবস্থায় পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের হাত-পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়। আনিসুর রহমান, আব্দুর রহমান, মালেক মাহমুদ, মোস্তাফিজুর রহমান, বজলুর রহমান, ফরহাদুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল মান্নানসহ অন্তত ১৫-২০ জন শিক্ষক এই ওসির রোষানলে পড়ে বিভিন্ন মামলার আসামি হয়েছেন। তাদের ওপর নির্যাতন এবং তাদের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে ওসি সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। তার সাথে থানায় কথা বলতে গেলে এক সাংবাদিককে ধরে তিনি ‘মাতলামি’র অজুহাত এনে তাকে হেনস্তা করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাংবাদিক জানান, একটি খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি সালাউদ্দিনের রোষানলে পড়েন এবং মিথ্যা অভিযোগে সালাউদ্দিন নিজে তাকে নাজেহাল করেন । বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়। কিন্তু সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অপর এক ফটো সাংবাদিককে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালান সালাউদ্দিন। মানুষ ধরে নিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার আরো অনেক অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, এতসব অভিযোগ থাকার পরেও সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সর্বশেষ তার থানায় সুজনের হত্যার পরেও তিনি বেঁচে গেলেন। পুলিশেরই একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তিনি ওই থানার ইনচার্জ। তার থানায় কোনো অঘটন ঘটলে অবশ্যই তিনি দায় এড়াতে পারেন না। এ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু এবারো তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বেই আছেন। একাধিক সূত্র জানায়, এর আগে আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বর্ণ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, এসব কর্মকর্তা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও তোয়াক্কা করেন না। আর অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা এসব কর্মকর্তাকে তোয়াজ করে চলেন।
No comments:
Post a Comment