Monday, August 25, 2014

পরিবহন চাঁদাবাজ ১৯৪ পুলিশ:কালের কন্ঠ

বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের সড়ক পরিবহনে পুলিশের চাঁদাবাজির বিষয় নতুন নয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে এই অসাধু কর্মকাণ্ড। পুলিশের কে, কোথায়, কিভাবে চাঁদাবাজি করে থাকে তা বের করার জন্য সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা দেশজুড়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানের পর সারা দেশে সড়ক পরিবহন সেক্টরের নিয়মিত চাঁদাবাজদের তালিকাসংবলিত একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে গোয়েন্দারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল
করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটি পাঠিয়ে দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সারা দেশে মোট ১৯৪ জন চাঁদাবাজ পুলিশের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় ইন্সপেক্টর থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশও রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ সদস্যরা চাঁদা ওঠানোর কাজে দুই শতাধিক দালাল নিয়োগ করেছেন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পুলিশের এই চাঁদাবাজির কারণে বাস মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলেন। বিশেষ করে ঈদ ও পূজার সময় এ দুর্ভোগ দুঃসহ মাত্রায় বেড়ে যায়। এ ছাড়া চাঁদাবাজির কারণে ট্রাকভাড়া বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দামও বাড়ানো হয় এবং তার মাসুল দিতে হয় ক্রেতা সাধারণকে। ওদিকে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির ফলে সাধারণ মানুষের মনে পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশও করা হয়েছে। তাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া এসব অনৈতিক কাজে যারা জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। সুপারিশে আরো বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহযোগী স্থানীয় কথিত দালালদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়টি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। দেখে বলতে হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, সেগুলো আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা সদস্যের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার সাভার এলাকায় ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. ফরহাদ হোসেন ও হেমায়েতপুর-আমিনবাজার এলাকায় পরিবহন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মুরাদ আহমেদ। তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে, দুজন টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) স্থানীয় বাসিন্দা মোমিন, আবুল হোসেন ও মোমিনকে (২) লাইম্যান হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে প্রতি গাড়ি থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। চাঁদাবাজির বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে মো. ফরহাদ হোসেন গত মঙ্গলবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমি জড়িত কি না সেটা তদন্ত করে দেখুক। যদি আমি জড়িত থাকি তাহলে আমার শাস্তি হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দালাল যাদের কথা বলা হয়েছে, তাদেরকে আমি চিনি না, জানিও না।’ ঢাকার কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোলচক্কর এলাকায় সার্জেন্ট শাহ আলম, এসআই আবদুল আজিজ, পিএসআই আবুল কালাম, কনস্টেবল মকবুল হোসেন, সাহাবুদ্দিন, সোহরাব ও মুজিবুর সরাসরি বাস-ট্রাক থেকে বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা আদায় করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।  মানিকগঞ্জ জেলার মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সার্জেন্ট বাসার, সার্জেন্ট হামিদ, ট্রাফিক কনস্টেবল শহিদুল ও বোরহান চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাঁরা চাঁদাবাজির জন্য সহযোগিতা নেন মানিকগঞ্জের রফিক মিয়া, মো. বোরহান মিয়া, ফিরোজ, পলাশ ও ফজলুর। পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় বিআইডাব্লিউটিএর সিনিয়র টার্মিনাল সুপার আবদুস সাত্তার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট জামাল পরিবহন থেকে চাঁদা নিয়ে থাকেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা সুযোগ বুঝে ফেরিতে পিকআপ ভাড়া ৭৪০ টাকার জায়গায় এক হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত বুধবার বিকেলে আবদুস সাত্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তো ভাড়া উঠাই না। আমি হলাম গ্রুপ লিডার। তাহলে আমি বেশি টাকা নেব কী করে?’ শেরপুর জেলার খোয়ারপাড় মোড়, শেরী ব্রিজ মোড়, থানা মোড়, মাদানীনগর ব্রিজ, সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে বিভিন্ন যাত্রাবাহী ও মালবাহী যানবাহন থেকে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. সিদ্দিকুর রহমান, ট্রাফিক সার্জেন্ট মাহবুবুর রহমান, টিএসআই মো. ইউনুস, ট্রাফিক হাবিলদার জয়নাল, ট্রাফিক কনস্টেবল আবু খালেক, মাহতাব উদ্দিন চাঁদাবাজি করেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাঁরাও এই চাঁদাবাজিতে স্থানীয়দের দালাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। দালালদের মধ্যে রয়েছে শেরপুর সদরের মো. আসলাম, মো. মোশাররফ হোসেন বুলবুল, মোস্তাক আহমেদ, মুক্তি, ফরহাদ হোসেন, রুপন, মঞ্জু মিয়াসহ আটজন। ময়মনসিংহর মুক্তাগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী রসুলপুর থেকে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে ডাকাতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতি রাতে ১০-১২ জন পুলিশ সদস্যকে ডিউটি দেওয়া হয়। এসব পুলিশ সদস্যকে মধুপুর থানা, আলোকদিয়া পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ডিউটি বণ্টন করে দেওয়া হয়। ডিউটিরত পুলিশ সদস্যরা প্রতিটি বাস-ট্রাক থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে উৎকোচ নিয়ে থাকেন। এই টাকা মধুপুর থানার ওসি মজিবুর রহমানের নির্দেশে আদায় করা হয় বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মধুপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস-ট্রাক থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বাস-ট্রাকের লোকজন টাকা দেবে কেন? পঁচিশ মাইল এলাকা থেকে রসুলপুর পর্যন্ত বন এলাকা। এ কারণে সেখানে রাতে পুলিশ ডিউটি করে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওসি কি নিজে গিয়ে বাস-ট্রাক থেকে টাকা আদায় করেন?’ ময়মনসিংহের চড়পাড়া মোড়, ব্রিজ মোড় ও নান্দাইলের চৌরাস্তা মোড়ে পুলিশ চাঁদাবাজি করে থাকে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। টিএসআই আবদুর রাজ্জাক, কনস্টেবল জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে প্রতিবেদন বলা হয়, তাঁরা ময়মনসিংহে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রাক থেকে ২০০ টাকা করে মাসোহারা নিয়ে থাকেন। পরে সেই টাকা ভাগবাটোয়ারা করা হয়। এ বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক নয়। ব্রিজে বাস-ট্রাক সরিয়েই সময় পাই না, চাঁদা নেব কখন?’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করে দেখেন কোনো অভিযোগের প্রমাণ পান কি না।’ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশে মোগড়াপাড়া থেকে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত পুলিশ বাস-ট্রাকে চাঁদাবাজি করে। নারায়ণগঞ্জ জেলার অভ্যন্তর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন স্পটে ট্রাফিক পুলিশ ও থানা পুলিশ চাঁদাবাজি করে থাকে। এ কাজে পুলিশ দালাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সোনারগাঁওয়ের নজরুল খান ওরফে ডাকাত নজরুল, সাহাব উদ্দিন, আশরাফসহ আরো কয়েকজনকে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া ঘাট, গজারিয়া উপজেলার মেঘনা ব্রিজ থেকে দাউদকান্দি ব্রিজের মধ্যবর্তী এলাকায় পুলিশ চাঁদাবাজি করে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর পুরাতন লঞ্চ ঘাট, পুলিশ ফাঁড়ি ও মুক্তারপুর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি করা হয়। মাওয়া ঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ খন্দকার খালিদ হাসান পরিবহনে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালিদ হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। আমি কোনো পরিবহন থেকে চাঁদা নিই না। ভুল করে কেউ অভিযোগ করে থাকতে পারে।’ কুমিল্লা শহরের মাকসুদুর রহমান টিটু, শাহ আলম, গোলাম মাওলা, আবুল কালাম আজাদ, আবুল কাশেম, দাউদকান্দির কামাল, হাবিব, চান্দিনার আবদুর রশীদ, চৌদ্দগ্রামের হিরণ হোসেন কুমিল্লা এলাকায় পরিবহনে চাঁদাবাজিতে পুলিশের দালাল হিসেবে কাজ করে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চৌদ্দগ্রামের সিএনজি ও বাসস্ট্যান্ড, মিয়ার বাজার বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি করেন এসআই মামুন, এএসআই অজিত বাবু ও ইন্দ্রজিৎ। লাকসাম বাজার বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছে এএসআই লুৎফর রহমান ও এসআই খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট বাসস্ট্যান্ডে ওসি মশিউর রহমান, এসআই এমদাদুল হক ও কনস্টেবল শাহীনের নামে এবং চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড ও ইলিয়টগঞ্জ বাজারে এসআই হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা, চৌমুহনী পূর্ব বাজার জোড় ব্রিজ, বেগমগঞ্জের জামান হোটেলসংলগ্ন এলাকায় পুলিশ চাঁদাবাজি করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি সদরের তিন মাথা মোড়, রেলগেট, জয়পুরহাট সদরের পাচুর মোড়, বাটার মোড় এলাকায় পুলিশকে চাঁদা দিতে হয় সব ধরনের পরিবহনকে। এসব চাঁদাবাজির সঙ্গে জয়পুরহাট সদর থানার ওসি মো. আ. রশিদ, আক্কেলপুর থানার ওসি মো. আবুল কালাম আজাদ ও সার্জেন্ট মো. মাহবুবুর রশিদ জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাঁরা মো. গোলাম মোস্তফা, জহুরুল ইসলাম, সুমন কুমার সাহাকে দালাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে এর বাইরেও আরো অনেক জেলা-উপজেলায় পরিবহনে চাঁদাবাজির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

No comments:

Post a Comment