৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আদায়ে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর আওতায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ বৈঠকগুলোর তথ্যবিভ্রাট ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ভ্রান্ত ধারণা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বারবার। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় সরকার এক দিকে কূটনীতিতে মার খাচ্ছে, অন্য দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের সাথে বৈঠক সম্পর্কে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তথ্যের বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের কাছে তা ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের বক্তব্যে প্রকৃত তথ্য উঠে এসেছে। ডেভিড ক্যামেরন ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আর বান কি মুন সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকগুলোর আলাপচারিতা সরকার ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করলে কূটনেতিক ক্ষেত্রে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কিনা জানতে চাওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ন কবির গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘অবশ্যই করে। এতে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। কারণ যারা আমাদের সাথে কথা বলছেন তারা তো সম্মানিত ব্যক্তি। তারা যদি দেখেন তারা যে কথা বলেননি সে কথাটা বলা হচ্ছে তাতে করে আমাদের প্রতি তাদের যে সম্মানবোধ রয়েছে তা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে। তারা বলেন, যারাই সরকারে থাকেন, তারা তো ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলেন। কাজেই আমরা আশা করতে পারি এই ১৬ কোটি মানুষের সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি তারা সজাগ থাকবেন।’ হুমায়ুন কবির বলেন, প্রধানমন্ত্রী কন্যাশিশু বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডন গেছেন। কন্যাশিশুর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে সে ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সবাই একমত। অন্য দিকে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের সাথে আলোচনায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সব সরকারই এসব ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু এর মধ্যে রাজনৈতিক উপাদান চলে আসায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্জনগুলো খাটো হয়ে যায়। তাই যে বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে সফর দু’টি হয়েছে তাতে মনোযোগী থাকলে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশের বিচ্ছিন্ন থাকার উপায় নেই মন্তব্য করে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচন যে একটি সমস্যা তা সবাই স্বীকার করে, এমনকি সরকারও স্বীকার করে। এখন সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে একে জাস্টিফাই (যথার্থতা) করার চেষ্টা করছে। যদি স্বীকারই করলাম, তবে সমস্যাটি সমাধানের উদ্যোগ নিলে ক্ষতিটা কী? উদ্যোগ নিলে এসব কথা বাইরে থেকে শুনতে হয় না। দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতাও জোরদার হয়। আর যেসব সামাজিক বা অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা আমরা বলছি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে তা নিয়ে সামনে অগ্রগর হওয়া যাবে না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রিটেন সফর শেষে গত ২৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদ আলী বর্তমান সরকারের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান পাল্টেছে বলে দাবি করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন এখন অতীত। যুক্তরাজ্য ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চায়। আগামী দিনে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাজ্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো নিবিড় করতে চায়। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে জোরদারের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশ সরকারের সাথে একযোগে কাজ করে যাবে। অন্য দিক গত ১৯ জুন নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সাথে আব্দুল হামিদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আব্দুল মোমেন জানান, রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেছেন যে সংলাপের ব্যাপারে সরকারের কোনো কার্পণ্য নেই। তবে তা হতে হবে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে। কেউ নির্বাচন বর্জন করলে সংলাপ হবে কিভাবে? মোমেন জানান, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন। ব্রিটেন সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’-এর কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত উচ্চ বা শীর্ষপর্যায়ের বৈঠকের পর মিশন ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমের কাছে কোন বিষয়ে কী বলছেন, তা আলোচনার মাধ্যমে পরিষ্কার করে নেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে বৈঠকের পর এ ধরনের আলোচনা না হওয়ায় ভিন্ন তথ্য এসেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মাহফুজুর রহমান নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, ডেভিড ক্যামেরনের সাথে বৈঠকের পরপরই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় গণমাধ্যমে ব্রিফ করা হয় যাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একই বক্তব্য ছিল। পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্রের বিবৃতিতে বাংলাদেশের বক্তব্যের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করা হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা সঠিক বলেই মনে করে। তবে শীর্ষপর্যায়ের একই বৈঠক সম্পর্কে ভিন্নধর্মী বক্তব্য যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে মাহফুজুর রহমান তা অস্বীকার করেননি।
No comments:
Post a Comment