Wednesday, August 13, 2014

৯০ ভাগ মৃত্যুই ৫৫ কিলোমিটারে:প্রথম অালো

দেশের মহাসড়কগুলোর ২০৯টি স্থানের প্রায় ৫৫ কিলোমিটারজুড়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল এসব এলাকায়। তবে নির্জন কোনো স্থানে নয়, বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে বাসস্ট্যান্ড ও বাজারের মতো জনবহুল এলাকায়। এই সামান্য পথের ব্যবস্থাপনায় নেই সঠিক পরিকল্পনা। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর সঠিক নীতিমালার অভাব। ‘সড়কে নিরাপত্তা: ব
াস্তবতা এবং প্রতিবন্ধকতাসমূহ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে গবেষণা-প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহায়তায় পরিচালিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। সড়ক দুর্ঘটনা-সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা; স্থানীয় মানুষ, যানবাহনের মালিক, সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে দলীয় আলোচনা; চালকদের ওপর একটি জরিপ এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ দুটি এলাকায় নিবিড় অনুসন্ধানের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে শুরু হয়ে চলতি বছরের প্রথম দিকে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিবছর তিন হাজার ১৩৭ জন মারা গেছে। এ সময় ৪৭ হাজার ৫৮৯টি দুর্ঘটনা ঘটে। এই ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যায় ২০০৮ সালে, তিন হাজার ৭৬৫ জন। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পাঁচটি জেলা সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ। এগুলো হলো কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা। ২০১২ সালে কুমিল্লায় সর্বোচ্চ, ১২৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। এরপর ঢাকায় ১০৫, টাঙ্গাইলে ১০২, সিরাজগঞ্জে ৯৬ ও চট্টগ্রামে ৯৫। দেশে জাতীয় মহাসড়কের পরিমাণ তিন হাজার ৫৮০ কিলোমিটার। ২০১২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা বলছে, মহাসড়কের সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে ৫৪ দশমিক ৭ কিলোমিটার এলাকায়। ওই বছরে সারা দেশে মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৬৩৭। এতে মারা গেছে দুই হাজার ৫৩৮ জন। এর মধ্যে ওই সাড়ে ৫৪ কিলোমিটারে এক হাজার ৫০৫টি দুর্ঘটনা ঘটে এবং মারা গেছে দুই হাজার ২৮৪। এই প্রায় ৫৫ কিলোমিটারের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, সাড়ে ১৬ কিলোমিটার। দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানের সংখ্যা ৩৮টি। অন্য দুর্ঘটনাস্থলের মধ্যে আছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার, নগরবাড়ী-বাংলাবান্ধা ৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার, নগরবাড়ী-রাজশাহী ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার, দৌলতদিয়া-ঝিনাইদহ-খুলনা ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার, ঢাকা-সিলেট ৫ দশমিক ১ কিলোমিটার, গাজীপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার, বঙ্গবন্ধু সেতু সংযোগ সড়ক ১ দশমিক ২ কিলোমিটার এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার। বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই হয় শহরাঞ্চলে। এর মধ্যে বাসস্ট্যান্ড এলাকার কাছাকাছি সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪১ শতাংশ দুর্ঘটনা হয়। এরপর বাজারের কাছের এলাকায় হয় ২৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। সংযোগ সড়কে ঘটে দুর্ঘটনার প্রায় ১৮ শতাংশ। অপ্রশিক্ষিত চালকদের হাতে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের বেপরোয়া চালনাকেই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গবেষণায়। আর মহাসড়কের পাশে বাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা, এসব জায়গায় ব্যবস্থাপনার অভাব সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কারণগুলোর উল্লেখ করে গবেষণাপ্রধান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব সমস্যা তৈরি হয়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুপযোগী গাড়ি চলে, রুট পারমিট দেওয়া হয়, রাস্তার পাশের জায়গা দখল করে বাজারসহ নানা স্থাপনা তৈরি হয়। গবেষণার সূত্র ধরে হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘যানবাহনের মালিকানা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালীদের হাতে। আর এ জন্য দুর্ঘটনার পর যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’ চালকের লাইসেন্সের বিষয়ে ঘুষ প্রদানের কথা স্বীকার করে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য, ‘আমি লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ৬০ শতাংশ কমিয়েছি। বাকি ৪০ শতাংশ এখনো রয়ে গেছে। তবে তা দূর করার চেষ্টা হচ্ছে।’ রাস্তার পাশে বাজার সৃষ্টিকে স্থানীয় সরকার পরিষদের বিষয় বলে মন্তব্য করেন যোগাযোগমন্ত্রী। গবেষণায় চালকদের ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, বাসের চালকেরাই সবচেয়ে বেশি (৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ) দুর্ঘটনা ঘটান। চালকদের ৮১ শতাংশ প্রশিক্ষণ ছাড়া, কেবল ওস্তাদদের কাছ থেকে শিখেই চালক বনে যান। চালকদের ৪৮ শতাংশই উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের শিক্ষিত। চালকদের প্রায় সবাই অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন। দেখা গেছে, ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা গাড়ি চালান ৪৮ শতাংশ চালক। প্রায় ১৯ শতাংশ চালক গাড়ি চালান ১৩ থেকে ১৬ ঘণ্টা। আবার এসব চালকের গ্রামে বাড়ি থাকলেও ৪১ শতাংশই ঘুমান গাড়িতে। পরিবহনমালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি খোন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহর দাবি, আন্তজেলা গাড়ির চালকদের অধিক সময় গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, ‘আমাদের ৬০-৭০ লাখ টাকার গাড়ি চলে। সেখানে আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি যেমন চালাই না, তেমনি দক্ষ চালক ছাড়া কারও হাতে গাড়িও দিই না।’ তবে কেবল চালকের কাছ থেকে তাঁদের সহযোগীরা গাড়ি চালনা শিখে ভালো চালক হতে পারেন বলেও মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া, ১৯৮৩ সালে সংশোধিত ১৯১৪ সালের মোটরযান অধ্যাদেশকে একটি ঔপনিবেশিক আইন হিসেবে উল্লেখ করে সেটির সংশোধনের তাগিদ দেওয়া হয়। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এসব আইন ও নীতিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। তবে তাঁর কথা, ‘রাতারাতি সবকিছু সম্ভব না।’

No comments:

Post a Comment