Wednesday, August 13, 2014

দুর্ঘটনা কমাতে সরকার নিষ্ক্রিয়!:প্রথম অালো

সড়কপথের মৃত্যুফাঁদ বলে কথিত স্থানগুলোকে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব। কিন্তু ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ছাড়া আর কোথাও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এখন সড়ক-সেতু নির্মাণ ও মেরামতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নেওয়া একটি প্রকল্প ছয় বছর ধরে ঝুলে আছে। আর প্রতিদিনই সড়কে ঝরে পড়ছে অমূল্য প্রাণ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্
যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় এসেছে, দেশে সারা বছর যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, এর ৩৫ শতাংশ ঘটে জাতীয় মহাসড়কের ৪ শতাংশ এলাকায়। মহাসড়কের ২০৯টি স্থানকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে এগুলোকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ নাম দিয়েছে এআরআই। এসব ব্ল্যাক স্পটের তালিকা ২০০৯ সালেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ১১টি স্থান বাদ দিলে তেমন কোনো কাজই হয়নি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার পথে মাত্র ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের বাঁক প্রশস্ত করার মাধ্যমে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) হিসাব মতে, এই মহাসড়কের ওই অংশে ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৭৫টি। ১১টি বাঁক প্রশস্ত করার পর ২০১৩ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা নেমে আসে ২৫টিতে। ২০১১ সালে মারা যায় ৯৬ জন। আর ২০১৩ সালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ জনে। আহতের সংখ্যাও কমেছে প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ। ২০১০ সালের চেয়ে ২০১২ সালেও একইভাবে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমেছে নবীনগর থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা উন্নয়নে সওজ প্রকল্প নেওয়ার কথা বলে আসছে ২০০৯ সাল থেকেই। ১৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই ছয় বছর চলে গেছে। সওজ সূত্র জানায়, ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় জনপ্রিয় চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ কয়েকজন মারা যান। মহাসড়কের এই অংশের বিপজ্জনক ২২টি বাঁক নিয়ে প্রথম আলোতে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে সময় সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। তখন সওজ বাঁক প্রশস্ত, সোজা ও তাতে সড়ক বিভাজক স্থাপন করার প্রকল্প নেয়। জানতে চাইলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন সিদ্দিক গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ব্ল্যাক স্পট উন্নয়নে প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে গেছে। অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হবে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় ও সওজ সব সময় বড় প্রকল্পের পেছনে ছোটে। কারণ, বড় প্রকল্পে নয়ছয়ের সুযোগ বেশি। এ জন্যই ছোট এবং জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তাদের আগ্রহ কম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগসচিব বলেন, এটা ঠিক নয়। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মন্ত্রণালয় এটাই করছে। দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান: সরকারের হিসাবে দেশে প্রতিদিন গড়ে আটজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের হিসাবে তা ৩০ জন। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১২-১৩ সালের হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ৪৮ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। ২০১১ সালে মস্কোতে জাতিসংঘ তার সদস্যদেশগুলোয় ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশও এর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা কিংবা কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ঈদুল ফিতরের আগে-পরে ২২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় ১০৮ জন এবং আহত হয় ৩৩৬ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে গত জানুয়ারি থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার হিসাব তৈরি করেছে। এই হিসাব অনুযায়ী, এ সময় দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় চার হাজার ১৮০টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয় চার হাজার ৭১৬ জন। আহত হয় আরও প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৩৭ শতাংশই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই ভয়াবহ বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে সরকার দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুলিশের হিসাবে, ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে প্রায় ৫০ হাজার দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, যাতে মারা যায় সাড়ে ৪২ হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত হয় প্রায় সমসংখ্যক। জানতে চাইলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়ক ও যানবাহনের ফিটনেস উন্নয়ন, চালকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মানুষকে সচেতন করতে হবে। ব্ল্যাক স্পটগুলো সমাধানের মাধ্যমে এই কাজ শুরু করা যায়।

No comments:

Post a Comment