। প্রশাসনের তদারকি আর অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করল নিরীহ যাত্রীরা। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দাবি, এমএল পিনাক-৬ নামের লঞ্চটিতে তিন শতাধিক যাত্রী ছিল। কিন্তু এর ধারণক্ষমতা ছিল ৮৫ যাত্রীর। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সব দেখে যাত্রীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার অনুমতি দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু সে নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে ঘাটে ঘাটে। সরকারি হিসাবে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত মাত্র দুজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এঁদের একজন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কাদিপুর এলাকার নূসরাত জাহান হিরা (২১)। তিনি শিকদার মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অপরজনের পরিচয় মেলেনি। ৪০ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। গত রাত ১২টা পর্যন্ত আরও অন্তত ১২৫ জনের পরিবার তাঁদের স্বজন নিখোঁজ হয়েছেন দাবি করে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কাছে নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। মাওয়া ঘাট সিবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দীনু খান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই মাওয়া ঘাটে থাকা ২৫টির মতো স্পিডবোট দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। বোটগুলো ৮০ থেকে ৯০ জনকে উদ্ধার করে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটির খোঁজে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জোরালো কোনো উদ্ধার তৎপরতাই শুরু হয়নি। ফায়ার সার্ভিস ঘটনার পরপর উদ্ধার তৎপরতায় নামলেও কোনো ফল দেখা যায়নি। চাঁদপুর থেকে গত রাত সাড়ে আটটায় দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশাসন) আবদুস সালাম বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চটি পানির ৭০ থেকে ৮০ ফুট গভীরে তলিয়ে গেছে। তীব্র স্রোত ও বড় বড় ঢেউয়ের কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এ অবস্থায় তাঁরা উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও নির্ভীকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। উদ্ধার তৎপরতায় দেরি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্বজনের খোঁজে আসা ব্যক্তিরা। কিন্তু সবাই যেন নিরুপায়। এর আগে গত এপ্রিলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এমভি মিরাজ-২ দুর্ঘটনায় ৫৬ জন যাত্রী মারা যায়। তখনো যথাসময়ে উদ্ধারকারী লঞ্চ আসতে পারেনি বলে অভিযোগ ছিল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ আর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, লঞ্চটির চলাচল অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নদী এখন উত্তাল, পদ্মায় ২ নম্বর সতর্কসংকেত দেখানো হচ্ছিল। এ অবস্থায় ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের লঞ্চ চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু ডুবে যাওয়া লঞ্চটি ছিল ৫২ ফুট লম্বা (সাড়ে ১৯ মিটার)। তবে এ দুর্ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একই ধরনের আরও কয়েকটি লঞ্চ মাওয়া ঘাট ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, লঞ্চটির জরিপ মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল গত এপ্রিলে। বিশেষ ব্যবস্থায় ৪৫ দিন ‘টোকেন’ নিয়ে চলছিল। টোকেন অনুমোদনের সময়ও পার হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। স্বজনদের খোঁজে আসা ব্যক্তিরা প্রশ্ন তুলেছেন, মাওয়া ও কাওড়াকান্দি দুই ঘাটে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দুজন পরিদর্শক রয়েছেন, রয়েছেন আরও কর্মকর্তারা। তাহলে চলাচলের অযোগ্য লঞ্চ ঘাট থেকে ছাড়ে কী করে। দুর্ঘটনার পর যথারীতি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর-উর রহমানের নেতৃত্বে। অন্যটি সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের জরিপকারক নাজমুল হকের নেতৃত্বে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তাঁদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে, গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় লঞ্চটি কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে ছাড়ে। বেলা ১১টার কিছু আগে এটি মাওয়া ঘাটের কাছে ডুবে যায়। লঞ্চের পাশে চলা একটি ফেরি থেকে এক যাত্রী লঞ্চ ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি ভিডিও করেছেন। তাতে দেখা যায়, লঞ্চটি ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বাঁ কাত হয়ে ডুবে গেছে। লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাওড়াকান্দি ছাড়ার সময় নদীতে প্রবল স্রোত ছিল। মাওয়ার কাছে আসার পর নদীতে দুই মানুষ সমান ঢেউ দেখা দেয়। যখন ঘাট দেখা যাচ্ছিল, তখন এ রকম একটি ঢেউ লঞ্চের ওপরে আছড়ে পড়ে। পানি ঢুকে যায় লঞ্চের ভেতরে। ভয়ে যাত্রীরা একদিকে জড়ো হলে লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যায়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে গেছেন। এত বিপুল যাত্রী নিয়ে এই ছোট্ট লঞ্চটি কীভাবে চলাচলের অনুমতি পেল—এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি নির্দেশ দিয়েছি অতিরিক্ত যাত্রী না নিতে। আমাদের তদারক দল থাকলে লঞ্চমালিকেরা কথা শোনে, অন্যথায় শোনে না।’ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও গেছেন ঘটনাস্থলে। রাতে সাড়ে আটটার দিকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ঘাটে এসে পৌঁছেছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত করা যায়নি। টাগবোট দিয়ে নদীর তলে দড়ি ফেলে অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে। উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক ঘটনাস্থলে এলেই পুরোদমে উদ্ধারকাজ শুরু হবে। পদ্মার পাড়ে নিরুপায় মুখগুলো: স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে যাওয়া যাত্রী রিনা রহমান (৩৫) পদ্মার তীরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বরিশালের বড়কোঠা উজয়পুর এলাকার রিনা রহমান আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমি এহন কি লইয়া বাঁচমু। দুই মেয়েকে তাদের বাবা ধরে রাখছিল। আর আমি ইমতিয়াজকে (ছেলে) বুকের মধ্যে ধরে রেখেছিলাম। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পরে ইমতিয়াজ কীভাবে যেন ছুটে যায়। এরপর আর কিছু বলতে পারব না। জেগে দেখি আমাকে এখানে এনে রাখা হয়েছে।’ রিনা রহমান গাজীপুরের পশ্চিম দেওদেবপুরে থাকেন। ঈদে তাঁরা পরিবার নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান (৪২) গাড়িচালক, দুই মেয়ে গাজীপুর মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী আমিন রহমান (১৮) ও আরফিন রহমান (১৬) এবং একমাত্র ছেলে গাজীপুরের শাহীন স্কুলের ছাত্র ইমতিয়াজ রহমান (৯)। রিনা রহমান এখন নিখোঁজ স্বজনদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। ছয় বছরের রাব্বিকে কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন ইমদাদুল হক। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ইমদাদুলের পরিবারের বেঁচে ফেরা একমাত্র সদস্য রাব্বি ও ভাগনে ১৯ বছরের রবিউল। নিখোঁজ আছেন ইমদাদুলের স্ত্রী মাকসু বেগম, চার বছরের মেয়ে মেরি ও আড়াই বছরের ছেলে হানিফ। লঞ্চডুবির খবর শুনে রাজধানীর নতুন বাজার থেকে ছুটে এসেছেন ইমদাদুল। নদীর স্রোত দেখে ভাটি অঞ্চলের মানুষ ইমদাদুল বুঝে গেছেন, যাঁরা গেছেন তাঁরা আর ফিরবেন না। গতকাল দুপুরে মাওয়া ঘাটের রেস্তোরাঁর কর্মী, বাস আর জলযানগুলোর কর্মীদের হাঁকডাক ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিল মানুষের কান্না আর বিলাপের শব্দ। নদীর পাড়ে স্বজনের খোঁজে ততক্ষণে জড়ো হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। নদীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই তাঁদের। যাঁরা নৌকা আর স্পিডবোট নিয়ে স্বজনের খোঁজে নদীতে নেমেছিলেন, তীব্র স্রোত আর ঢেউয়ের বাধায় তাঁরাও ঘাটে ফিরে এসেছেন। তাঁদের চোখ এখন সরকারি সংস্থাগুলোর দিকে। মন্ত্রী, সাংসদেরা ভেঁপু বাজিয়ে আসছেন-যাচ্ছেন। কিন্তু দেখা নেই উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম আর নির্ভীকের। সন্ধ্যার দিকে কথা বলতে গেলেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন স্বজনেরা। শরীয়তপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন আলী জব্বার। কিন্তু শুধু নিজের জীবন নিয়ে ভেজা শরীরে একটি স্পিডবোটে উঠতে পেরেছেন। তীরে বসে বিলাপ করছিলেন, ‘সকালেও একসাথে ছিলাম, এহন দুন্যায় একা হইয়া গেলাম রে।’ দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বোনের মেয়েকে নিয়ে মাদারীপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন রাশেদা বেগম। দুই ছেলে আর রাশেদা বেঁচে ফিরেছেন। মেয়ে আফরোজা আর ইমা নিখোঁজ। এরা দুজনেই রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে পড়ত। রাশেদা জানান, তাঁর স্বামী হায়দার আলী ইতালিপ্রবাসী। ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করবেন—এ ইচ্ছায় তাঁদের নিয়ে ঢাকায় রেখে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন তিনি। এখন সব শেষ। ১৫ বছর বয়সী রিমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিলা জখম, পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে শরীয়তপুর থেকে আসা এই কিশোরী। নিজের বোন-ভাই ও খালা-খালুকে হারিয়েছে সে। মাওয়া ঘাটে এ রকম গল্প নিয়ে অসংখ্য মানুষ কাঁদছেন, ঘুরছেন। কিন্তু নিখোঁজ স্বজনদের উদ্ধারে কেউই কিছু করতে পারছেন না।
Headlines from most popular newspapers of Bangladesh. বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনামগুলো এক নজরে দেখে নিন।
Tuesday, August 5, 2014
অব্যবস্থাপনার বলি নিরীহ যাত্রীরা:প্রথম অালো
। প্রশাসনের তদারকি আর অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করল নিরীহ যাত্রীরা। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের দাবি, এমএল পিনাক-৬ নামের লঞ্চটিতে তিন শতাধিক যাত্রী ছিল। কিন্তু এর ধারণক্ষমতা ছিল ৮৫ যাত্রীর। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সব দেখে যাত্রীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার অনুমতি দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু সে নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে ঘাটে ঘাটে। সরকারি হিসাবে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত মাত্র দুজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এঁদের একজন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কাদিপুর এলাকার নূসরাত জাহান হিরা (২১)। তিনি শিকদার মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অপরজনের পরিচয় মেলেনি। ৪০ জন জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। গত রাত ১২টা পর্যন্ত আরও অন্তত ১২৫ জনের পরিবার তাঁদের স্বজন নিখোঁজ হয়েছেন দাবি করে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কাছে নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। মাওয়া ঘাট সিবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দীনু খান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই মাওয়া ঘাটে থাকা ২৫টির মতো স্পিডবোট দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। বোটগুলো ৮০ থেকে ৯০ জনকে উদ্ধার করে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটির খোঁজে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জোরালো কোনো উদ্ধার তৎপরতাই শুরু হয়নি। ফায়ার সার্ভিস ঘটনার পরপর উদ্ধার তৎপরতায় নামলেও কোনো ফল দেখা যায়নি। চাঁদপুর থেকে গত রাত সাড়ে আটটায় দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশাসন) আবদুস সালাম বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চটি পানির ৭০ থেকে ৮০ ফুট গভীরে তলিয়ে গেছে। তীব্র স্রোত ও বড় বড় ঢেউয়ের কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এ অবস্থায় তাঁরা উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও নির্ভীকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। উদ্ধার তৎপরতায় দেরি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্বজনের খোঁজে আসা ব্যক্তিরা। কিন্তু সবাই যেন নিরুপায়। এর আগে গত এপ্রিলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এমভি মিরাজ-২ দুর্ঘটনায় ৫৬ জন যাত্রী মারা যায়। তখনো যথাসময়ে উদ্ধারকারী লঞ্চ আসতে পারেনি বলে অভিযোগ ছিল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ আর সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, লঞ্চটির চলাচল অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নদী এখন উত্তাল, পদ্মায় ২ নম্বর সতর্কসংকেত দেখানো হচ্ছিল। এ অবস্থায় ৬৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের লঞ্চ চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু ডুবে যাওয়া লঞ্চটি ছিল ৫২ ফুট লম্বা (সাড়ে ১৯ মিটার)। তবে এ দুর্ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে একই ধরনের আরও কয়েকটি লঞ্চ মাওয়া ঘাট ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, লঞ্চটির জরিপ মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল গত এপ্রিলে। বিশেষ ব্যবস্থায় ৪৫ দিন ‘টোকেন’ নিয়ে চলছিল। টোকেন অনুমোদনের সময়ও পার হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। স্বজনদের খোঁজে আসা ব্যক্তিরা প্রশ্ন তুলেছেন, মাওয়া ও কাওড়াকান্দি দুই ঘাটে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের দুজন পরিদর্শক রয়েছেন, রয়েছেন আরও কর্মকর্তারা। তাহলে চলাচলের অযোগ্য লঞ্চ ঘাট থেকে ছাড়ে কী করে। দুর্ঘটনার পর যথারীতি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর-উর রহমানের নেতৃত্বে। অন্যটি সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের জরিপকারক নাজমুল হকের নেতৃত্বে। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তাঁদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে, গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় লঞ্চটি কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে ছাড়ে। বেলা ১১টার কিছু আগে এটি মাওয়া ঘাটের কাছে ডুবে যায়। লঞ্চের পাশে চলা একটি ফেরি থেকে এক যাত্রী লঞ্চ ডুবে যাওয়ার দৃশ্যটি ভিডিও করেছেন। তাতে দেখা যায়, লঞ্চটি ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বাঁ কাত হয়ে ডুবে গেছে। লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রী রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাওড়াকান্দি ছাড়ার সময় নদীতে প্রবল স্রোত ছিল। মাওয়ার কাছে আসার পর নদীতে দুই মানুষ সমান ঢেউ দেখা দেয়। যখন ঘাট দেখা যাচ্ছিল, তখন এ রকম একটি ঢেউ লঞ্চের ওপরে আছড়ে পড়ে। পানি ঢুকে যায় লঞ্চের ভেতরে। ভয়ে যাত্রীরা একদিকে জড়ো হলে লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যায়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ঘটনাস্থলে গেছেন। এত বিপুল যাত্রী নিয়ে এই ছোট্ট লঞ্চটি কীভাবে চলাচলের অনুমতি পেল—এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি নির্দেশ দিয়েছি অতিরিক্ত যাত্রী না নিতে। আমাদের তদারক দল থাকলে লঞ্চমালিকেরা কথা শোনে, অন্যথায় শোনে না।’ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও গেছেন ঘটনাস্থলে। রাতে সাড়ে আটটার দিকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ঘাটে এসে পৌঁছেছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চটি শনাক্ত করা যায়নি। টাগবোট দিয়ে নদীর তলে দড়ি ফেলে অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে। উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক ঘটনাস্থলে এলেই পুরোদমে উদ্ধারকাজ শুরু হবে। পদ্মার পাড়ে নিরুপায় মুখগুলো: স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বেঁচে যাওয়া যাত্রী রিনা রহমান (৩৫) পদ্মার তীরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বরিশালের বড়কোঠা উজয়পুর এলাকার রিনা রহমান আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমি এহন কি লইয়া বাঁচমু। দুই মেয়েকে তাদের বাবা ধরে রাখছিল। আর আমি ইমতিয়াজকে (ছেলে) বুকের মধ্যে ধরে রেখেছিলাম। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পরে ইমতিয়াজ কীভাবে যেন ছুটে যায়। এরপর আর কিছু বলতে পারব না। জেগে দেখি আমাকে এখানে এনে রাখা হয়েছে।’ রিনা রহমান গাজীপুরের পশ্চিম দেওদেবপুরে থাকেন। ঈদে তাঁরা পরিবার নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান (৪২) গাড়িচালক, দুই মেয়ে গাজীপুর মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী আমিন রহমান (১৮) ও আরফিন রহমান (১৬) এবং একমাত্র ছেলে গাজীপুরের শাহীন স্কুলের ছাত্র ইমতিয়াজ রহমান (৯)। রিনা রহমান এখন নিখোঁজ স্বজনদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। ছয় বছরের রাব্বিকে কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন ইমদাদুল হক। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ইমদাদুলের পরিবারের বেঁচে ফেরা একমাত্র সদস্য রাব্বি ও ভাগনে ১৯ বছরের রবিউল। নিখোঁজ আছেন ইমদাদুলের স্ত্রী মাকসু বেগম, চার বছরের মেয়ে মেরি ও আড়াই বছরের ছেলে হানিফ। লঞ্চডুবির খবর শুনে রাজধানীর নতুন বাজার থেকে ছুটে এসেছেন ইমদাদুল। নদীর স্রোত দেখে ভাটি অঞ্চলের মানুষ ইমদাদুল বুঝে গেছেন, যাঁরা গেছেন তাঁরা আর ফিরবেন না। গতকাল দুপুরে মাওয়া ঘাটের রেস্তোরাঁর কর্মী, বাস আর জলযানগুলোর কর্মীদের হাঁকডাক ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছিল মানুষের কান্না আর বিলাপের শব্দ। নদীর পাড়ে স্বজনের খোঁজে ততক্ষণে জড়ো হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ। নদীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই তাঁদের। যাঁরা নৌকা আর স্পিডবোট নিয়ে স্বজনের খোঁজে নদীতে নেমেছিলেন, তীব্র স্রোত আর ঢেউয়ের বাধায় তাঁরাও ঘাটে ফিরে এসেছেন। তাঁদের চোখ এখন সরকারি সংস্থাগুলোর দিকে। মন্ত্রী, সাংসদেরা ভেঁপু বাজিয়ে আসছেন-যাচ্ছেন। কিন্তু দেখা নেই উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম আর নির্ভীকের। সন্ধ্যার দিকে কথা বলতে গেলেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন স্বজনেরা। শরীয়তপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন আলী জব্বার। কিন্তু শুধু নিজের জীবন নিয়ে ভেজা শরীরে একটি স্পিডবোটে উঠতে পেরেছেন। তীরে বসে বিলাপ করছিলেন, ‘সকালেও একসাথে ছিলাম, এহন দুন্যায় একা হইয়া গেলাম রে।’ দুই ছেলে, এক মেয়ে আর বোনের মেয়েকে নিয়ে মাদারীপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন রাশেদা বেগম। দুই ছেলে আর রাশেদা বেঁচে ফিরেছেন। মেয়ে আফরোজা আর ইমা নিখোঁজ। এরা দুজনেই রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল কলেজে পড়ত। রাশেদা জানান, তাঁর স্বামী হায়দার আলী ইতালিপ্রবাসী। ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করবেন—এ ইচ্ছায় তাঁদের নিয়ে ঢাকায় রেখে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন তিনি। এখন সব শেষ। ১৫ বছর বয়সী রিমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিলা জখম, পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে শরীয়তপুর থেকে আসা এই কিশোরী। নিজের বোন-ভাই ও খালা-খালুকে হারিয়েছে সে। মাওয়া ঘাটে এ রকম গল্প নিয়ে অসংখ্য মানুষ কাঁদছেন, ঘুরছেন। কিন্তু নিখোঁজ স্বজনদের উদ্ধারে কেউই কিছু করতে পারছেন না।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment