‘সকালে আমার সবাই ছিল। এখন আমার কেউ নাই। আমি কেন মরে গেলাম না। আল্লাহ যে কেন আমারে বাঁচাইয়া রাখল।’ পদ্মার তীরে এভাবেই বিলাপ করছিলেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার কসবাঘট্রি এলাকার সৈয়দ মো. সাদি (৩৭)। গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পদ্মার তীরে সাদির সঙ্গে কথা হয়। গতকাল মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে প্রচণ্ড স্রোত ও ঢেউয়ের তোড়ে পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবে যায়। অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ওই লঞ্চেই ছিলে
ন মো. সাদির স্ত্রী শেফালী, দুই ছেলে আরিফ (সাড়ে ৮) ও এনাম (সাড়ে ৪)। এখন তারা নিখোঁজ। চার সদস্যের পরিবারে একমাত্র সাদিই বেঁচে আছেন। সাদি ঢাকায় ইউনুস গ্রুপে কাজ করেন। ঈদের ছুটি কাটিয়ে তিনি পরিবার নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। সাদি বিলাপ করতে করতে প্রথম আলোকে বলেন, মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে লঞ্চে ওঠেন। বেলা ১১টার দিকে লঞ্চটি মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি আসে। ঘাট থেকে আধা কিলোমিটারের মতো দূরে থাকতে প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে লঞ্চটি দুলছিল। লঞ্চটি প্রথমে এক পাশে কাত হয়। এরপর অপর পাশে কাত হয়েই ডুবে যায়। এ সময় তিনি দুই হাতে দুই সন্তানকে ধরে রাখেন। স্ত্রীকে বলেন তাঁর প্যান্টের পেছনে ধরে রাখতে। লঞ্চটি ডুবে গেলে তিনি তলায় গিয়ে পড়েন। দুই হাত থেকে ছুটে যায় দুই ছেলে। স্ত্রী প্যান্টের পেছনের পকেটের অংশ ছিঁড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে। এরপর তিনি ভেসে উঠলে একটি সিবোট এসে তাঁকে উদ্ধার করে। স্ত্রী তাঁর প্যান্টের যেখানে ধরে রেখেছিলেন, সেই ছিঁড়ে যাওয়া অংশটি দেখিয়ে কাঁদতে থাকেন সাদি। নদীর ঘোলাপানির দিকে তাকিয়ে বুক চাপড়ে বললেন, ‘তোগোরে আমি নদীতে ভাসাইয়া দিলাম। কত স্বার্থপর আমি।’ মাওয়া ঘাটে ভাই-ভাবি ও ভাতিজা-ভাতিজিকে খুঁজতে ছুটে এসেছেন ছোট ভাই কোহিনুর হাওলাদার। তিনি প্রথম আলোকে জানান, এঁদের সঙ্গে তাঁরও আসার কথা ছিল। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হওয়ায় তাঁকে পরের লঞ্চে আসতে হয়েছে। আসার সময় শোনেন, আগের লঞ্চটি ডুবে গেছে। এরপর তাঁর ভাই ও ভাবির ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঢাকার বাসায় খবর নিয়ে দেখেছেন, তাঁরা পৌঁছাননি। কোহিনুর জানান, তাঁর ভাই জালাল হাওলাদার (৪৫) ঢাকার কোনাবাড়ীতে ব্যবসা করেন। ভাই, ভাবি রুমি আক্তার (৩০), ভাতিজি সাদিয়া (১৪) ও ভাতিজা সাগর (৬) এখন নিখোঁজ। লঞ্চ দুর্ঘটনায় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ডাসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সবুজ কাজির পরিবারের চারজন নিখোঁজ রয়েছেন। মা হিরণ নেসা, স্ত্রী তিশা ময়না, ছেলে তৌফিক ও শ্যালক আল আমিন। নিখোঁজ রয়েছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ঠাট্টা গ্রামের বাহাদুর ইসলামের স্ত্রী আয়শা এবং দুই মেয়ে সারা ও রোজিনা। স্বজনদের খোঁজে পদ্মার তীরে অপেক্ষা করছেন বাহাদুর ইসলাম। হাসি বেগম বেঁচে গেলেও তাঁর ছেলে ইপা (১৫), মিরাজ (৯) ও মেয়ে মাহি (১৭ মাস) নিখোঁজ রয়েছে। হাসি বেগম বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আমার বুকের ধন সবাই শেষ হয়ে গেছে।’ খবর শুনে তাঁর স্বামী সেতু বিভাগে কর্মরত রহিম মাদবর ঢাকা থেকে ছুটে আসেন। রহিম মাদবর জানান, তাঁরা ঢাকার গুলশানের নতুন বাজারে থাকেন। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভান্ডারীকান্দি গ্রামে। ঈদের ছুটি কাটিয়ে তিনি গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় চলে আসেন। স্ত্রী ও সন্তানেরা আজ (গতকাল সোমবার) আসছিল। গতকাল দুপুর থেকে পদ্মা তীরে সাদি, হাসির মতো আরও বহু লোক স্বজনদের খোঁজে আহাজারি করছেন। মাওয়া ঘাটে পদ্মার শোঁ শোঁ বাতাসে তাঁদের কান্না আর হা-হুতাশ মিশে অবর্ণনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে সন্ধানপ্রার্থী স্বজনের সংখ্যা। তাঁদের এ অপেক্ষার শেষ কোথায় কেউ জানে না।
No comments:
Post a Comment