Monday, September 1, 2014

পানি কমছে, বাঁধ ভাঙা এলাকায় আতঙ্ক:কালের কন্ঠ

দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। তবে প্রধান নদীগুলোর পানি একযোগে কমতে শুরু করায় দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গতকাল রবিবার ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মার পানি সামান্য কমলেও বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি গত শুক্রবার থেকেই বিপৎসীমার নিচ দিয়ে বইছে। তবে তিস্তার পানি কমতে থাকায় আরে
ক বিপদ নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করছে। নতুন করে বাঁধ ভাঙা, ভাঙা বাঁধ আরো বড় হওয়া এবং চরাঞ্চল মিলিয়ে গতকাল কয়েকটি জেলায় আরো শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্য দিকে বন্যার পানিতে ডুবে শেরপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে তিন শিশুসহ সাতজন মারা গেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ : শেরপুর : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। চরাঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ এখনো বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রভাবে মৃগী ও দশানি নদীর পানি বাড়ায় শেরপুর পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। অন্য দিকে, সদর উপজেলার ‘কজওয়ের’ বানের পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে আব্দুর রশিদ (১৪) নামের সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার বিকেলে নিখোঁজ হওয়ার পর গতকাল সকালে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। সে চরশ্রীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র এবং কান্দাপাড়া গ্রামের জানিক মিয়ার ছেলে। এ ছাড়া কামারের চর এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবন্ত আউশ ধান কাটতে গিয়ে সমেজ উদ্দিন (৪০) নামের এক কৃষক শনিবার সন্ধ্যায় পানিতে ডুবে মারা যান। নিহত সমেজ উদ্দিন চরমোচারিয়া ইউনিয়নের চরবাববনা গ্রামের কিতাব উদ্দিনের ছেলে। চরশেরপুর ইউনিয়নের যোগিনীমুড়া খড়িয়া গ্রামের জমসেদ আলী (৬৫) নামের এক ব্যক্তি বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যান। কুড়িগ্রাম : নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রে ১৯ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। তাতে এখনো বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। নুন খাওয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে নতুন করে প্রায় পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া রৌমারী-রাজীবপুর সড়কের শিবেরডাঙ্গীতে ২০ ফুট অংশ ভেঙে নতুন করে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্য দিকে, বন্যার পানিতে ডুবে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের দীঘল হাইলা গ্রামের শাহানাজ বেগম (৩০) মারা গেছেন। রৌমারী (কুড়িগ্রাম) : বন্যার পানির চাপে রৌমারী-রাজীবপুর সড়কের শিবেরডাঙ্গী নামক স্থানে ভেঙে গেছে। এর ফলে রৌমারী থেকে রাজীবপুর, জামালপুরসহ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বগুড়া : গত ২৪ ঘণ্টায় সারিয়াকান্দি পয়েন্ট যমুনার পানি ১১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। ফলে গতকাল রবিবারও নতুন নতুন জনপদ প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুসারে সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি গ্রাম নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে। অন্য দিকে, গতকাল দুপুরে সারিয়াকান্দি উপজেলার চন্দনবাইশা ইউনিয়নের ঘুঘুমারী গ্রামে মাছ ধরতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে রবিউল ইসলাম (১২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়। ঘটনার ছয় ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। শরীয়তপুর : জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে দুই সেন্টিমিটার কমে গতকাল বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গতকাল জাজিরা ও ভেদরগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে প্রায় অর্ধশত গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, এই দুই উপজেলাসহ নড়িয়া ও গোসাইরহাট উপজেলায় দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রবল স্রোতে পদ্মায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গত ১৫ দিনে পদ্মার ভাঙনে জেলার নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তরতরাবনিয়া ইউনিয়নের ৫০০ পরিবার গৃহহীন হয়েছে। সিরাজগঞ্জ : গতকাল যমুনার পানি সামান্য কমলেও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। সকালে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গতকাল ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে সাত সেন্টিমিটার কমেছে। তবে করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর, গুমানি, বাঙালিসহ শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় শাহজাদপুর উপজেলার বানতিয়ার চরে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় এই চরের আশরাফ আলীর এক বছর বয়সী মেয়ে ডালিয়া বাড়ির উঠানের বন্যার পানিতে পড়ে যায়। কাজীপুর উপজেলার মেঘাই রিং বাঁধ ভাঙায় নতুন করে তিনটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বন্যাকবলিত রয়েছে। রংপুর : জেলায় তিস্তার পানি গত শুক্রবার থেকে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে বইছে। তবে পানি কমার আরেক বিপদ নদীভাঙন তীব্র হয়েছে। নদীর ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ, ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ ও পুনর্বাসনের দাবিতে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মানববন্ধন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো গতকাল ভাঙনকবলিত ব্যাঙপাড়া এলাকায় এ মানববন্ধন করে। গাইবান্ধা : সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে রবিউল ইসলাম প্রভাত (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার পশ্চিম বেলকা (জুগিপাড়া) গ্রামের ইমদাদুল হকের ছেলে। গতকাল দুপুরে নিখোঁজ হওয়ার পর বাড়ির পাশে বন্যার পানি থেকে তার ভাসমান মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সুন্দরগঞ্জ থানায় এ ব্যাপারে অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। অন্য দিকে, গাইবান্ধা জেলায় গতকাল থেকে ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি দ্রুত কমতে শুরু করেছে। তবে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত। গতকাল ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে বন্যাউপদ্রুত ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় ব্যাপক ভাঙনে গত দুই দিনে ছয় শতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়েছে। রাজবাড়ী : পদ্মার রাজবাড়ী জেলার অংশে পানি সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজবাড়ীর ভাগ্যকূল পয়েন্টে ৩ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল দুপুর পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যায় জেলা সদরের মিজানপুর, বরাট ও দাদশী ইউনিয়নের এবং পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে থাকা নদীতীরবর্তী এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। মুন্সীগঞ্জ : জেলায় গতকাল বন্যা পরিস্থিতির রবিবার আরো অবনতি হয়েছে। মুন্সীগঞ্জে পদ্মার পানি ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল সকাল ৬টায় বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। এতে শ্রীনগর, লৌহজং, মেদিনীমণ্ডল, সিরাজদিখান, টঙ্গিবাড়ী ও সদর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়। চাঁদপুর : দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি মেঘনা দিয়ে দক্ষিণের সাগরে তীব্র স্রোত নিয়ে নামছে। এমন পরিস্থিতিতে তিন নদীর মোহনা হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন এলাকার বেশ কিছু সিসিব্লক দেবে গেছে। রবিবার দুপুরে এ ঘটনার পর সেখানে ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসমাইল হোসেন জানান, স্রোতের তোড়ে প্রায় ৭০-৮০ মিটার এলাকা ডেবে গেছে। অন্য দিকে আগের দিন মেঘনায় পানি বিপৎসীমার মাত্র ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল তা ২৯ সেন্টিমিটারে ওঠে। এ ছাড়া জোয়ারে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। হঠাৎ করে মেঘনা ও শাখা নদীগুলোতে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে চাঁদপুরে এক ধরনের বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment