রাজধানীর শেরে বাংলানগর ও শ্যামলী-আগারগাঁওজুড়ে রয়েছে আটটি সরকারি বিশেষায়িত ও একটি জেনারেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সেই সঙ্গে আছে একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল। সব মিলিয়ে এসব হাসপাতালে প্রায় এক হাজার ৫০০ আবাসিক এবং এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আউটডোর রোগীর চিকিৎসা চলে প্রতিদিন। তবে সরকারি এ স্থাপনাগুলোর ঠিক উল্টো দিকেই শ্যামলী থেকে আসাদ গেট হয়ে ধানমণ্ডির দিকে যেতে পায়ে পায়ে মেলে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক। এক
ক হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছাড়াও কোথাও কোথাও একই ভবনে চোখে পড়ে একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল। তবে এর কোনটি আসল আর কোনটি ভুয়া, তা বোঝার উপায় নেই সাধারণ রোগীদের। কারণ মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ঠিক সামনেই চিশতিয়া হোটেলের ওপর টিনের ছাপরাঘরে হার্ডবোর্ডের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা একটি বেসরকারি ভুয়া ক্যান্সার হাসপাতালের অস্তিত্ব ধরা পড়ে সম্প্রতি র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতে। সেখানে চারটি কেবিনসহ ১৮টি বেড সাজিয়ে ‘ভয়াবহ পরিবেশে’ চলে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের কেমোথেরাপিসহ নানা চিকিৎসা। এ ঘটনার পর রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ভুয়া হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়, যদিও বেশ আগে থেকেই এ পরিস্থিতির কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভিযানে হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনা খুবই কম। সরেজমিন অনুসন্ধানে আসাদ গেটের পাশে লালমাটিয়া আবাসিক এলাকার ভেতরেই গুনে গুনে পাওয়া যায় ১৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এর আশপাশে পুরো মোহাম্মদপুর-ধানমণ্ডি এলাকায় ছোট-বড় বেসরকারি হাসপাতাল আছে ৫০টিরও বেশি। সরকারি হিসাব মতেই পুরো ঢাকা শহরে এমন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় ৮০০। আর সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার, যা গড়ে উঠেছে গত ৩২ বছরে। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা এসব হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে এখন সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই হিমশিম খাচ্ছে। বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেরই নেই চিকিৎসার উপযুক্ত পরিবেশ, অবকাঠামো কিংবা যন্ত্রপাতি। জনবলও নেই পর্যাপ্ত। চিকিৎসাসেবার নামে শুধু ব্যবসায়িক মুনাফা লাভের জন্যই চালানো হয় প্রতিষ্ঠানগুলো। রোগীদের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক হাতিয়ে নেয় সাধারণ মানুষের অর্থকড়ি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত দুই-তিন দশকে চিকিৎসাসেবার নামে ব্যবসায়িক প্রবণতা খুবই বেড়ে গেছে। অসাধু লোকজন এ ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। এই খাতকে এখন দ্রুত ধনী হওয়ার মওকা হিসেবে দেখছে অনেকে। এরা চিকিৎসাকে সেবা হিসেবে না নিয়ে ব্যবসার ফাঁদ হিসেবে নিয়েছে। এ কারণে যেমন ভুয়া ও অপচিকিৎসার মাত্রা বেড়ে গেছে, মানুষ হয়রানি ও প্রতারিতও হচ্ছে অহরহ। অন্যদিকে সরকারের তরফ থেকে নেই যথেষ্ট তদারকির ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ১৯৮৪ সালের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইনটির দ্রুত পরিবর্তন ও যুগোপযোগী করার তাগিদ দিয়েছেন অনেকেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের নজরদারি না থাকার ফলেই হাসপাতালের নামে চিকিৎসা ব্যবসার ফাঁদ পাতার সুযোগ পাচ্ছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত আইন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। জানতে চাইলে এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনুমোদন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. এ বি এম আবদুল হান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক-দুই দিনে এসব হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি, দীর্ঘ সময় ধরে এগুলো গড়ে উঠেছে। এগুলো উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার আওতায় রাখা এখন আমাদের জন্য অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার সময় ভুয়া কাগজপত্র, অবকাঠামো ও জনবল দেখানো হয়, যা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পক্ষে যাচাই করা মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বিধি-বিধান অনুসারে অনুমোদন দেওয়ার আগে যখন আমাদের বিশেষ টিম পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণে যায়, তখন অন্য কোনো ভবনে সাইনবোর্ড লাগিয়ে, বেড-আসবাব, চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারী সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখানোর নজির আমাদের কাছে ধরা পড়েছে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। যাঁরা আছেন তাঁরা চেষ্টা করছেন। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ভুয়া হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার কয়েকটিকে নোটিশ করার পর তারা নিজেদের শুধরে নিয়েছে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ৮০০ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ১০ ও ২০ বেডের। এক শর বেশি বেডের হাসপাতালের সংখ্যা ৩৫। বাকিগুলো ১৫, ২৫, ৩০, ৪০ ও ৫০ বেডের। এ ছাড়া এক বেডের ক্লিনিকও আছে অনেক। আছে দুই থেকে দশের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্কের বেডসংবলিত হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অনুমোদন দেওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মহলের তদবির লেগে থাকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাদের কিছুই করার থাকে না। প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক বা চিকিৎসক নেতাই বেশি তদবির করেন। আর এসব বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের বেশির ভাগেরই মালিক নামে-বেনামে বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক। বড় হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের সমস্যা এবং ছোট বা মাঝারিগুলোর ক্ষেত্রে আরেক ধরনের সমস্যা থাকে। অনেক সময়ই অনেক হাসপাতালে অভিযান চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হতে হয়। ডা. এ বি এম আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ক্ষমতাও নেই। অভিযানের জন্য আমাদের ধরনা দিতে হয় জেলা প্রশাসনের ওপর। তাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটই আমাদের ভরসা।’ রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ঠিক সামনেই চিশতিয়া হোটেলের ওপর টিনের ছাপরাঘরে হার্ডবোর্ডের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা হয় একটি বেসরকারি হাসপাতাল। হাসপাতালে চারটি কেবিনসহ মোট ১৮টি বেড সাজানো হয়। চলে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের কেমোথেরাপিসহ নানা চিকিৎসা। বিনিময়ে রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। হঠাৎ করেই গত ১৩ মার্চ র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম আনোয়ার পাশা ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে উপস্থিত হন ওই হাসপাতালে। অভিযান শেষে সিলগালা করে দেওয়া হয় হাসপাতালটি। দুজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কালের কণ্ঠকে জানান, সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের কয়েক শ গজ দূরত্বে ওই কথিত হাসপাতালটি ছিল পুরোপুরি অবৈধ। কোনো অনুমোদন ছিল না, ছিল না উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত জনবল। এমনকি সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসকও ছিল না। দুই-তিনজন কর্মচারীই ছিলেন সর্বেসর্বা। বেশি প্রয়োজন মনে করলে তাঁরা সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালের নির্ধারিত কোনো কোনো চিকিৎসককে ডেকে আনতেন। আর এভাবে প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছিল ওই অবৈধ হাসপাতালের ‘ব্যবসা’। ওই ভুয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগী আবুল হাসেম জানান, তাঁরা প্রথমে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে তাঁরা আসেন ওই হাসপাতালে। মাত্র তিনজন কর্মচারীই চালাচ্ছিলেন হাসপাতালটি। চিকিৎসায় তাঁর অবস্থার কোনো উন্নতি না হয়ে বরং আরো খারাপ হয়ে পড়ে। কবির হোসেন নামের আরেক রোগী জানান, বিউটি নামের এক নার্সই কেমো ইনজেকশন দেওয়া থেকে সব চিকিৎসা দিতেন। র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বিউটি জানান, তিনি এখানকার সব রোগীর চিকিৎসা দেন। রোগীদের স্যালাইন, রক্ত ও কেমো ইনজেকশন তিনি দিয়ে থাকেন। তিনি এ বিষয়ে দক্ষ না হয়েও দুই বছর ধরে এখানে এ কাজ করেন। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক প্রভাবশালী ওয়ার্ডবয় গড়ে তুলেছিলেন এ ভুয়া হাসপাতাল। এর আগে গত ২৮ এপ্রিল র্যাব-৪ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল-আমীনের নেতৃত্বে রাজধানীসংলগ্ন ধামরাই ও আশুলিয়া থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একাধারে ভুয়া হাসপাতাল ও ভুয়া ডাক্তার শনাক্ত করা হয়। ধামরাইয়ে মালেকা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ১৩ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়। অভিযানকালে মো. সুরুজ খান নামে একজনকে আটক করা হয়। সুরুজ সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে কর্মরত বিএমডিসির রেজিস্টার্ড সরকারি ডাক্তার শেখ তৈয়েবুর রহমানের এমবিবিএস ও বিএমডিসির সনদ জাল করে দীর্ঘদিন ধরে রোগী দেখেন ও প্রেসক্রিপশন দেন। সুরুজকে বিএমডিসি আইন ২০১০-এর ২৮ ও ২৯ ধারা লঙ্ঘনের অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই অভিযানে আরো কয়েকজন ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
No comments:
Post a Comment