Wednesday, September 17, 2014

সাঈদীর চূড়ান্ত রায় আজ:কালের কন্ঠ

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায় ঘোষণা হচ্ছে আজ বুধবার। আপিল বিভাগ রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখার ঘোষণা দেওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় চূড়ান্ত রায় দিতে যাচ্ছেন। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর আদালতে আজকের দৈনন্দিন কার্যতালিকার ১ নম্বরে রাখা হয়েছে এ মামলা। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে এ কার্যতালিকা প্রকাশিত হয়
েছে এবং বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার জন্যই মামলাটি কার্যতালিকায় রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গত ১৬ এপ্রিল সাঈদীর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। জামায়াতের আরেক নেতা কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তি করে রায় দেওয়ার পর এ ধরনের দ্বিতীয় কোনো মামলায় আপিল বিভাগ আজ রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে আপিল বিভাগে সাঈদীর আপিল ও সরকারপক্ষের আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয় এবং চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল শুনানি শেষ হয়। আপিলের শুনানিতে সরকারপক্ষ মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার আবেদন জানিয়েছে। আর সাঈদীকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়েছেন তাঁর আইনজীবীরা। এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গতকাল বিকেলে নিজ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করে বলেছেন, ‘আমি তো তাঁর মৃত্যুদণ্ড চাই। ট্রাইব্যুনাল যেসব অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, আপিল বিভাগ সেসব অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখবেন বলে প্রত্যাশা করছি। অন্য অভিযোগেও মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন আপিল বিভাগ।’ এ মামলায় রিভিউয়ের সুযোগ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি আগে থেকেই বলে এসেছি, এ মামলাটি বিশেষ আইনের মামলা। এ আইনে রিভিউয়ের সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘কাদের মোল্লার মামলায় আসামিপক্ষ রিভিউ আবেদন করেছিল। আপিল বিভাগ ওই আবেদন শুনানি শেষে খারিজ করে দেন। ওই রায়ের কপি আমি এখনো পাইনি। ওই কপি পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, এ মামলায় রিভিউয়ের সুযোগ আছে কি না।’ অন্যদিকে সাঈদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বেকসুর খালাস পাবেন বলে আশা করছি। এ মামলা নিয়ে সারা দুনিয়ার আগ্রহ রয়েছে।’ আপিল বিভাগে সাঈদীর মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দ্বিতীয় মামলার বিচার সম্পন্ন হচ্ছে। এর আগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তি করা হয়। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লার আপিলের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ দণ্ড গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়। এ ছাড়া আপিল বিভাগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল বিচারাধীন। এগুলোর মধ্যে কামারুজ্জামানের করা আপিলের শুনানি দু-এক দিনের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমকে পাঁচ ধরনের অপরাধে মোট ৯০ বছর কারাদণ্ড ও অন্য তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এ ছাড়া আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এর বিরুদ্ধে আলীম আপিল করলেও ইতিমধ্যে তিনি মারা যাওয়ায় তাঁর করা আপিল গতকাল অকার্যকর ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দুটি ট্রাইব্যুনাল থেকে এ পর্যন্ত ৯টি মামলায় ১০ জনকে সাজা দেওয়া হয়। এ ছাড়া জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী, সাবেক মন্ত্রী ও হবিগঞ্জের জাতীয় পার্টি নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার, ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনের রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত রায়ে সাঈদীর ফাঁসির আদেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আটটি অভিযোগে সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এর মধ্যে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিশাবালী নামের দুজনকে হত্যার দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দুটি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় বাকি ছয়টিতে কোনো সাজা দেননি ট্রাইব্যুনাল। অন্য ১২টি অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে না পারায় সেগুলো থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার পর সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে গুজব রটিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশজুড়ে অরাজকতা সৃষ্টি করে। এতে ব্যাপক প্রাণ ও সম্পদহানি ঘটে।  এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৮ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন সাঈদী। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষও একটি আপিল করে। যেসব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দেওয়া হয়েছে সেসব অভিযোগে শাস্তি দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষে এ আপিল করা হয়। যেসব অভিযোগ প্রমাণিত : সাঈদীর বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, ধর্মান্তরিত করার অভিযোগসহ মোট ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- এক. শান্তি কমিটির এক দল লোক নিয়ে সাঈদী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ৭ মে পিরোজপুরের পারেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার সমর্থকদের দোকান ও বাড়িতে হামলা চালান। সেখানে মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের সোনা ও রুপা লুট করেন সাঈদী। দুই. সাঈদীর নেতৃত্বে এক দল সশস্ত্র লোক একাত্তরের ৮ মে দুপুর দেড়টায় পিরোজপুর সদর থানার ভাদুরিয়া গ্রামে নুরুল ইসলাম খানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে দেয় ওই বাড়ি। তিন. সাঈদীর নেতৃত্বে এক দল লোক ২ জুন সকাল ৯টায় নলবুনিয়ায় আবদুল হালিম বাবুলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। চার. একই দিন সকাল ১০টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তাঁর সহযোগীরা পিরোজপুরের উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় চিত্তরঞ্জন তালুকদার, জহর তালুকদার, হারেন ঠাকুর, অনীল মণ্ডল, বিশাবালী, সুকাবালী, সতিশবালার বাড়িসহ ২৫টি বাড়িতে হামলা চালায়। বিশাবালীকে নারিকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে হত্যা করা হয়। সাঈদী সরাসরি ওই সব কাজে অংশ নেন। পাঁচ. একই দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পিরোজপুরের টেংরাখালীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর ছোট ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সম্পদ লুট করে তারা। ছয়. মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০ থেকে ৬০ জন রাজাকার পিরোজপুরের হোগলাবুনিয়ায় হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। সেখানে ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে গ্রামের মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামীকে আটক করে ধর্ষণ করা হয়। হিন্দুপাড়ায় আগুন দেওয়া হয়। সাত. সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যের একটি দল পারেরহাট বন্দরের উমেদপুরে গৌরাঙ্গ সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁর তিন বোন মহামায়া, অন্যরানী ও কমলা রানীকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেয়। সেখানে তাঁরা টানা তিন দিন ধর্ষণের শিকার হন। আট. স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সাঈদী রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে মধুসূদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, ডা. গণেশ সাহা, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হালদার, শান্তি রায়, হরি রায়, ফকির দাস, টোনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা, হরিদাস, গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন মহামায়া, অন্যরানী ও কমলা রানীসহ ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তর করেন। সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা : ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েই ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। এ মামলায়ই প্রথম অভিযোগ গঠন করা হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ২১ জুলাই তদন্ত শুরু হয়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুর ও হিন্দু সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে ধর্মান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী ৩২টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উত্থাপন করে। ১৪ জুলাই তা বিচারের জন্য আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর সেই বছরের ৩ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল ২০টি অপরাধে সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর। রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ মোট ২৮ জন সাক্ষ্য দেন। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৬ সাক্ষীর জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ শেষ পর্যন্ত ১৯টি অভিযোগের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষী উপস্থাপন করে। এরপর ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর থেকে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়। আসামিপক্ষে ১৭ জনের সাফাই সাক্ষ্য শেষ হয় ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর। ৫ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়; শেষ হয় ৬ ডিসেম্বর। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর দায়ের করা একটি মামলায় সাঈদীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ নভেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

No comments:

Post a Comment