Wednesday, September 3, 2014

দেশের নারী-বৈষম্যের করুণ চিত্র জাতিসংঘে:প্রথম অালো

জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদে স্বাক্ষর করার ৩০ বছর পরেও বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা কমেনি। জাতিসংঘের এক বিশেষ প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ঘরে বা বাইরে প্রতিনিয়ত সহিংসতার ঝুঁকির মধ্যে থাকেন বাংলাদেশের নারীরা। আর সহিংসতার অন্যতম কারণই হচ্ছে নারী ও পুরুষের মধ্যকার অসমতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। বিশেষ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মা
নুষ মনে করে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা যায়। প্রায় ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তাঁর পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন। এখানে নারীর প্রতি সহিংসতাগুলোর মধ্যে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে, এর পরেই রয়েছে ধর্ষণ। এমনকি বাংলাদেশে এমন অনেক সহিংসতাও আছে, যা রাষ্ট্রই ঘটায় বা রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বাংলাদেশের নারীদের পরিস্থিতি সম্পর্কে এই মূল্যায়ন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের নারীর প্রতি সহিংসতাসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি বা স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার রাশিদা মঞ্জুর। আর এই প্রতিবেদনটি রাশিদা মঞ্জু গত এপ্রিলে জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তরে জমা দিয়েছেন। এরপর এটি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ২৬তম অধিবেশনে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে নানা ধরনের উদ্বেগজনক তথ্য দেওয়া হয়েছে। রাশিদা মঞ্জু প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য গত বছরের ২০ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ছিলেন। প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে সরকারের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘকে নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে বাংলাদেশ যেসব কাজ করছে, তার বিবরণ দিয়ে বলেছে, নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাশিদা মঞ্জু বলেছেন, বাংলাদেশে নারীরা পরিবারেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হন। ২০১৩ সালের প্রথম আট মাসে যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ৩২৭টি ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১১০ জনকে হত্যা করা হয়, নয়জন আত্মহত্যা করেন আর ২০৮ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এখানে নারীর প্রতি সহিংসতার বড় হাতিয়ার হচ্ছে অ্যাসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণ। ২০১৩ সালের প্রথম আট মাসে ২২ জন নারী অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হন। অন্যদিকে একই সময়ে ধর্ষণের ৬৬১টি ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ছিল ১৮৮টি। এসব ঘটনায় ৪৯ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল, আর পাঁচজন নারী ঘটনার পর আত্মহত্যা করেছিলেন। রাশিদা মঞ্জু বলেছেন, গ্রাম্য সালিসের নামেও নারীকে নির্যাতন করা হয়, ফতোয়া দেওয়া হয়। অনেক নারীই সহিংসতার বিচার চাইতে প্রথাগত সালিসব্যবস্থায় যান। কিন্তু তা নারীকে আরও বেশি সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। ফতোয়া দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার পর অনেক নারীর আত্মহত্যা করার ঘটনাও রয়েছে। আর হিন্দু দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। নারী হওয়ার পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে। বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা হলেও বাংলাদেশে এখনো এটি একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। গ্রামে অধিকাংশ পরিবার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে। এ ক্ষেত্রে ভুয়া জন্মসনদ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। রাশিদা মঞ্জু প্রতিবেদনে আরও বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাঁর পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে সেখানে অধিকাংশ যৌন সহিংসতা ঘটিয়েছে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরা এবং এসব অপরাধের জন্য তাদের বিচার হয়নি। আবার তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দেখেছেন, অল্প পরিসরে বেশি নারী বন্দী রাখার কারণে তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা হয় না। তাঁরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা ও আইনগত সুবিধা পান না। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগেরও ব্যবস্থা নেই। এগুলোকে তিনি বলেছেন রাষ্ট্র কতৃ‌র্ক সংঘটিত কিংবা ব্যবস্থা নেওয়া হয় না এমন সহিংসতা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারী অধিকারভিত্তিক সংগঠন এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে, তাদের প্রতিনিধিরাও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। নারী মানবাধিকার নিয়ে কাজ করায় কেবল যে তাঁরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তা নয়, নারী হওয়ার কারণেও তাঁদের সহিংসতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাংলাদেশে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা নারী মানবাধিকারকর্মীরা হয়রানির শিকার হন, তাঁদের নানাভাবে কলঙ্কিত করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে, মৌখিক হুমকি, প্রশাসনিক হয়রানি এবং যৌন হয়রানি। এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনায় শাস্তিও হয় না। এ ছাড়া নারী মানবাধিকারকর্মীরা বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা অপহৃত হওয়া। মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বন্দী করাসংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য গত দুই বছরে বাংলাদেশ সরকারের নজরে আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে সরকার গত দুই দশকে বেশ কিছু আইন, নীতিমালা ও কর্মসূচি নিলেও নারী প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অনেক আইন করলেও সচেতনতার অভাব, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং প্রতিকার পেতে নারীর বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। যৌতুকবিরোধী আইন থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগ নেই। আক্রান্ত নারী ও তাঁর পরিবারের প্রতি হুমকি এবং প্রয়োজনীয় ফরেনসিক প্রমাণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। একটি অভিযোগ নথিভুক্ত করতেও পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়, নয়তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের শরণাপন্ন হতে হয়। আবার পুলিশ ও ডাক্তারের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, অপরাধীর প্রভাব, সম্পদ ও শক্তি সহিংসতার শিকার নারীর তুলনায় অনেকাংশে বেশি থাকায় তা পুলিশের ওপর এবং তদন্তে প্রভাব ফেলে। যৌন সহিংসতার তদন্ত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলো কে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রতিবেদনগুলো উদ্দেশ্যমূলক। সহিংসতার অভিযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা করা হয় না। তবে তিনি দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা না থাকার কথা স্বীকার করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে নারীরা যে বৈষম্যের শিকার, তার বড় উদাহরণ ঘরে, খামারে, পারিবারিক ব্যবসার ক্ষেত্রে কাজ করলেও তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। শ্রম আইন থাকলেও নারীরা এর সুফল পান না। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের যৌন হয়রানি রোধে ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ দেন। আইন প্রণয়নের আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে আইনের খসড়া তৈরি হলেও গত তিন বছরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক সম্পদের সহজলভ্যতা নারীর জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করলেও বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ অনেক ক্ষেত্রেই বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করছে। ক্ষুদ্রঋণের কারণে সহজে অর্থ পাওয়া যায় বলে গ্রামে অনেক স্বামী বা তাঁর পরিবার স্ত্রীকে বারবার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। যৌতুকের দাবি মেটানোর জন্য ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া না হলেও গ্রামে অনেক পরিবার এ উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রঋণ নেয়। এ ছাড়া যেসব নারী ক্ষুদ্রঋণ নেন, তাঁরা তা সময়মতো পরিশোধ করার ক্ষেত্রে প্রায়শ সমস্যার মুখোমুখি হন, যা তাঁকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। ঋণ পরিশোধ প্রায়ই ভীতি ও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মৌলিক প্রয়োজনসমূহ ত্যাগ করে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। রাশিদা মঞ্জু বলেছেন, বাংলাদেশের সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলেও অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় নারী নীতিতে নারীদের প্রতি সহিংসতা রোধ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী নারীদের সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। নীতি বাস্তবায়নে একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু গত তিন অর্থবছরে এর কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো অর্থই ব্যয় হয়নি। জাতিসংঘের এ প্রতিবেদন বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তরিক-উল-ইসলাম প্রথম আলো কে বলেন, প্রতিবেদনে ঢালাও অভিযোগ করা হয়েছে। এরপর তিনি সেগুনবাগিচায় নারীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল তৈরি এবং নারীদের আইনি সেবা দেওয়ার জন্য ৪০ জেলা ও ২০ উপজেলায় কেন্দ্র খোলার কথা জানান। জাতিসংঘ সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান সালমা খান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কে বলেন, ‘সরকারের করা জরিপে নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে, তার ৫০ শতাংশ হয়তো আমরা ধারণা করতাম। সে তুলনায় রাশিদা মঞ্জু নির্যাতনের যে তথ্য দিয়েছেন, বলতে গেলে তিনি কমই বলেছেন। আর জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি যখন এ ধরনের প্রতিবেদন দেন, তিনি সেই দেশটির সরকারের জরিপ ও বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য ব্যবহার করেই দেন। প্রতিবেদনের সবশেষ অংশে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার সংস্কার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং একটি স্বাধীন জাতীয় নারী কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সিডও সনদের ২ ও ১৬.১ অনুচ্ছেদের বিষয়ে বাংলাদেশের জানিয়ে আসা আপত্তি তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাশিদা মঞ্জু। বিয়ে, বিচ্ছেদসহ, সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনের বাইরে একটি অভিন্ন সাধারণ আইন তৈরির প্রস্তাব আছে সনদের এই দুই ধারায়।

No comments:

Post a Comment