Sunday, September 14, 2014

তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে দেশ:নয়াদিগন্ত

তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে দেশ। বিদ্যুৎসঙ্কট মেটাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও সারা দেশে বিদ্যুতের সঙ্কট কাটছে না। বরং এ সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গত কয়েক দিনে খোদ রাজধানীতেই দফায় দফায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে মানুষ। ভাদুরে গরমে ইট-বালু ঘেরা রাজধানীতে টেকাই দায় হয়ে পড়েছে। সঙ্কট মেটাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার
চেষ্টা করা হচ্ছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর সাড়ে ৫৫ কোটি টাকার তেল পোড়ানো হয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর পোড়ানো হয়েছে ৫১ কোটি টাকার তেল। গতকাল শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনেও দফায় দফায় লোডশেডিং করা হয়েছে। জুমার নামাজের সময়ও অনেক মসজিদে মাইক বন্ধ হয়ে যায় লোডশেডিংয়ের কারণে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিজে থাকা খাবার সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। ঠিকমতো চার্জ না হওয়ায় আইপিএসও  বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বলা চলে মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, তারা চাহিদানুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না। গ্যাসসঙ্কটের কারণে দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদনক্ষমতার কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যবধান বেড়ে গেছে। এ ব্যবধান কমাতে তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেশি হারে উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তেলের খরচ বেড়ে গেছে। এর সাথে পিডিবির ভর্তুকিও বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হবে না। বরং এ সঙ্কট আরো বেড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখা। কিন্তু সার উৎপাদনের কারণে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করতে গিয়ে পিডিবির গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পিডিবির দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর সাত হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ছয় হাজার ১৩৩ মেগাওয়াট। প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। পিডিবির ওয়েবসাইটে ওই দিনের পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, শুধু গ্যাসসঙ্কটের কারণেই উৎপাদন কম দেখানো হয়েছে এক হাজার ৫৫৭ মেগাওয়াট, আর সংস্কারের জন্য বন্ধ দেখানো হয়েছে এক হাজার ৮৩৬ মেগাওয়াট। ওই দিন ৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার তেল পোড়ানো হয়েছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগে গড়ে ৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করত পেট্রোবাংলা। এরপরও প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হতো গ্যাসের অভাবে। কিন্তু এখন তারা সর্বোচ্চ গ্যাস পাচ্ছেন ৮০ কোটি ঘনফুট। এ কারণে আগের চেয়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলা গ্যাস উৎপাদন করেছে ২৩৬ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ১৩৭ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৮০ কোটি ঘনফুট। আর সার কারখানাগুলোয় প্রায় ২৯ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চাহিদানুযায়ী গ্যাস উৎপাদন বাড়েনি। গ্যাস সেক্টরে শুধু ফাঁকা আওয়াজই করা হয়েছে। কিন্তু কাক্সিত হারে গ্যাস উৎপাদন বাড়েনি। বিদ্যমান গ্যাসকূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা হয়নি। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, এ কারণে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্ধিত হারে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনক্ষমতার চেয়েও বেশি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। যেমন, গত ১১ সেপ্টেম্বরে ২৩১ কোটি ঘনফুট উৎপাদন ক্ষমতার বিপরীতে উৎপাদন করা হয়েছে ২৩৬ কোটি ঘনফুট। অধিক হারে গ্যাস উৎপাদনের ফলে ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে গ্যাস ক্ষেত্রগুলো। ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাক্সিত হারে গ্যাস উৎপাদন না হওয়ায় বর্ধিত চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। এক দিকে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে গেলে আরেক দিকে ঘাটতি হচ্ছে। সীমিত উৎপাদন দিয়ে বার্ধিত চাহিদা মেটাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন, রমজানের কারণে সার কারখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখন জাতীয় প্রয়োজনে সার কারখানাগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। আর এ কারণেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ওই কর্মকর্তা মনে করেন, শুধু গ্যাসের কারণেই নয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সঠিকভাবে তদারকি করলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরো বাড়ত। পিডিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার দায়মুক্তি দিয়ে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। বলা হয়েছিল স্বল্প মেয়াদের জন্য এ বিদ্যুৎকেন্দ্র। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসবে সরকার। কিন্তু মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎই এখন একমাত্র ভরসা। আবারো তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের বোঝা চাপানো হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের ওপর। আবারো এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট তেলভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আর এটি অনুমোদন হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। আর এ জন্য আবারো গ্রাহকের ওপর বাড়তি মূল্যের খড়গ চাপবে বলে আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। এ দিকে বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করেও গ্রাহকেরা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। কয়েক দিন ধরে রাজধানীতে দিনে রাতে সাত থেকে আট বার লোডশেডিং করা হচ্ছে। আর রাজধানীর বাইরে গ্রামের কথা তো বলাই মুশকিল। বেশির ভাগ গ্রামেই সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ থাকে না। কখন আসে আর কখন বিদ্যুৎ থাকে তা অনেকেই বলতে পারেন না। ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর বাসিন্দা ও শিল্পোদ্যোক্তারা। ইট-বালু ঘেরা এ রাজধানীতে বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। একে তো ভাদুরে গরম, এরওপর ঘনঘন লোডশেডিং হাঁপিয়ে উঠেছেন রাজধানীর বাসিন্দারা। রামপুরা থেকে সেলিম হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, দিনে তো অফিসে থাকেন। অফিসে জেনারেটর থাকায় লোডশেডিংয়ের কষ্ট কম বোঝেন। কিন্তু রাতে বাসায় গিয়ে বুঝতে পারেন লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা। সারা দিন পরিশ্রম করে বাসায় গিয়ে দেখেন বিদ্যুৎ নেই। রাতে কয়েক দফা লোডশেডিংয়ের কারণে তিনি ঠিক মতো ঘুমাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। সাগর নাম এক কলেজপড়–য়া ছাত্র বলেন, রাতে পড়ার টেবিলে মন বসাতে পারেন না। কারণ ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বাসায়  টেকাই দায় হয়ে পড়ে। একে তো ভ্যাপসা গরম, তারওপর লোডশেডিং ও মশার যন্ত্রণায় তারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। কামরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক জানান, চার পাশে মাদকের ছড়াছড়ি। বিদ্যুৎ না থাকলেই ছেলেটি গরমের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে। সবসময় উদ্বিগ্নে থাকেন ছেলেটি কোনো খারাপ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মাদকসেবী হয়ে পড়ে কি না। মিরপুর থেকে জহিরুল ইসলাম নামে এক বিদ্যুৎগ্রাহক জানান, বিদ্যুৎবিল ছয়-সাত বছর আগে যা পরিশোধ করতেন এখন করতে হচ্ছে তার তিন গুণ। কিন্তু লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে তারা রক্ষা পাচ্ছেন না। বরং দিন দিন তা তীব্র আকার ধারণ করছে। বিদ্যুতের এ দুর্ভোগ থেকে তারা কবে রেহাই পাবেন তা আল্লাহই ভালো জানেন। 

No comments:

Post a Comment