শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা না ছড়িয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। ‘পাসের হার বাড়ছে : শিক্ষার মান বাড়ছে না কমছে?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘শিক্ষার মান কমছে না, মান বাড়ছে। কিন্তু আমরা যে মান অর্জনের জন্য লড়াই করছি তা অর্জন করতে পারিনি। সেই মান অর্জনের জন্য ক্রমান্বয়ে আগাতে হবে। এটাই এখ
ন আমাদের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ। যাঁরা বলছেন শিক্ষার মান কমছে, তাঁরা অবিচার করছেন। তাঁরা একটি প্রজন্মের মধ্যে হতাশা ছড়াচ্ছেন।’ দেশের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান এ বৈঠকের আয়োজন করে। গতকাল শনিবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া সেন্টারে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বৈঠকে সঞ্চালক ছিলেন ডেইলি সান সম্পাদক আমীর হোসাইন। সূচনা বক্তব্য দেন কালের কণ্ঠের সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। আলোচনায় অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, নর্দান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এম শামসুল হক, লেখক অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান চান ও বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সম্পাদক নঈম নিজাম। ধন্যবাদ বক্তব্য দেন বসুন্ধরা গ্রুপের উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুল ওয়াহিদ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের হতাশাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবছরই পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফল ভালো হচ্ছে। পাসের হার বাড়ছে। কিন্তু কিছু লোক আছেন, যাঁরা এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছেন। ছেলেমেয়েরা পাস করলে আমরা কী করব! কোনো শিক্ষক কিংবা মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের ফেল করার জন্য পড়ান না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ৪২ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ইংরেজিতে মাত্র দুজন পাস করায় শিক্ষার মান নিয়ে বিভিন্ন মহলে এর সমালোচনা হচ্ছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ৪২ হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে তাঁরা কি মাত্র দুজনকে পড়াবেন! যদি তারা ঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে অনুরোধ জানাব, এই দুজনকেই যেন তারা পড়ান। তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, অন্য ছেলেমেয়েরা কি যোগ্যতা রাখে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার? চান্স না পাওয়াটা কি ছেলেমেয়ের দোষ নাকি পরীক্ষা এবং পরীক্ষা পদ্ধতির? দয়া করে ছেলেমেয়েদের এভাবে হতাশাগ্রস্ত করবেন না। বিশ্বের সব দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিযোগিতা আছে মন্তব্য করে মন্ত্রী আরো বলেন, দুনিয়ার সব দেশে উচ্চশিক্ষা লাভের প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সবাই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় না। তার মানে তারা কি মেধাবী নয়? তাদের শিক্ষার মান খারাপ? মোটেও তা নয়। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘গেল বছর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা বৈঠক করলেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে প্রায় সবাই রাজি হলেন, কেবল দুই-একটি অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা রাজি হলেন না। এবার তাঁরা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিনই ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে দিলেন, যাতে আমরা সমন্বিত ভর্তি উদ্যোগ না নিতে পারি।’ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘বোর্ডের পরীক্ষার কোনো ত্রুটি থাকলে বলেন, আমরা সংশোধন করব। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে কথা কেউ বলেননি। তাহলে তা মানবেন না কেন, তার ভিত্তিতে ভর্তি করাবেন না কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফল প্রকাশের পর বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যেন আমরা অপরাধ করেছি। ১১ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে যেন মাত্র দুজন ভর্তির যোগ্য, আর কেউ নয়। যদিও ভিসি সাহেব বলেছেন, এই পরীক্ষার সঙ্গে পাস-ফেলের সম্পর্ক নেই। ছয় হাজার জনকে নেওয়ার জন্য তাঁরা শুধুই বাছাই করছেন।’ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে পারছি না এটা আমাদের ব্যর্থতা। প্রতিবছর দেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার ভর্তি বাণিজ্য হচ্ছে।’ শিক্ষা ক্ষেত্রে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামোর কথা চিন্তা করা হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া দক্ষতা বাড়াতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে শিক্ষকদের। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতায় আসছে না। অন্য পেশা না পেয়ে শেষমেশ এসে শিক্ষক হচ্ছে।’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিও শর্ত পূরণ করছে না। দেশের ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় কিছু কিছু শর্ত পূরণ করেছে, করার চেষ্টা করছে। তা ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে আমরা বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিয়েছি, যেন শিক্ষার্থীরা প্রতারিত না হয়।’ নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘বাস্তব জীবনে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষার্থীদের সেই জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। বর্তমান দুনিয়ার সঙ্গে মানানসই করে তুলতে হলে আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কেবল বড় ডিগ্রি দিয়ে হবে না। বাস্তব জীবনের সঙ্গে শিক্ষাকে মেলাতে না পারলে কোনো শিক্ষাই কাজে লাগবে না। শৈশবে একটি শিশু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললে সে কখনো সাহসী হয়ে উঠতে পারবে না। আর আত্মবিশ্বাস না বদলালে আমরা দেশ বদলাতে পারব না। তাই আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা ও জ্ঞানে দক্ষ করে গড়ে তুলতে চাই। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’ অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের চাহিদা অনেক বেড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় জোগান বাড়েনি। যোগ্য শিক্ষকের খুবই অভাব। শিক্ষক ভালো না হলে শিক্ষার্থী ভালোভাবে জানবে না। তাই স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষার প্রত্যাশিত মান আমরা পাচ্ছি না। এ থেকে উত্তরণ করতে হলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।’ ভর্তি পরীক্ষায় ফেল প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তির জন্য মাত্র দুই শিক্ষার্থী পাস করল, তার মানে ১১ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে দুইজন যোগ্য। প্রশ্নের ধরনের ওপর পাস-ফেল সব কিছু নির্ভর করে। পাস করানোর জন্য প্রশ্ন এক রকম হতে পারে, ফেল করানোর জন্য আরেক রকম হতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিফট করে পড়ালেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে দেশের এত শিক্ষার্থী যাবে কোথায়। ড. শামসুল হক বলেন, গ্রেডিং পদ্ধতি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। তাই শিক্ষকদেরও সেই ভাবেই গড়ে তুলতে হবে। তাঁরা ঠিকমতো প্রশ্ন করতে পারছেন কি না দেখতে হবে। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, ‘আমাদের স্কুলের লেখাপড়ার মান খুবই খারাপ। এমএ পাস করলেই শিক্ষক হওয়া যায়। মাস্টারি আসলে ডাক্তারি পেশার মতোই। কিভাবে পড়ালে পড়াশোনাটা কাজে লাগবে সেটা নির্র্ভর করে মাস্টারের ওপর।’ ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষায় পাসের হার বাড়া অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে কি না সেটা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। ইংল্যান্ডে দেখেছি প্রতিবছরের ফলাফলে পাসের হার বাড়ে, সেখানেও এ নিয়ে বিতর্ক হয়। নিউজিল্যান্ডেও একই অবস্থা। পাসের হার বাড়াটা নেতিবাচক নয়। পাসের হার বাড়ছে; কারণ সমাজের সর্বস্তর থেকেই শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তা ছাড়া পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে পাসের হার বাড়ছে। কারণ পরীক্ষার ট্রাডিশনাল পদ্ধতি ভেঙে এখন ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে শিক্ষার মানের বিষয়টিও পরিবর্তন হয়েছে। সেভাবেই আমাদের বিবেচনা করতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক হারে ফেল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু আমাদের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিগত সমস্যা আছে। যাঁরা পরীক্ষা পরিচালনা করছেন, যাঁরা প্রশ্ন করেছেন তাঁরা দায়ী। ইমদাদুল হক মিলন বলেন, শিক্ষা নিয়ে যে ব্যাপক কাজ হচ্ছে তাতে আশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখে দেশের মানুষ চমকে উঠেছে। ইংরেজি বিভাগে দুজন মাত্র চান্স পেয়েছে। কোনো রহস্য আছে কি না, কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না, পাসের হার বেড়েছে, কিন্তু মান বাড়ছে কি না এ বিতর্কের জবাব আমরা পেতে চাই। নঈম নিজাম বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র দুজন যখন পাস করে তখন প্রশ্ন দেখা দেয় গলদটা কোথায়। নিয়োগ দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিয়োগপ্রার্থীরা ইংরেজি থেকে বাংলায় ভালো অনুবাদ করতে পারছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আসার পরও তারা ভালো ইংরেজি পারছে না। তিনি বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা এখনো মূল ধারার শিক্ষার সঙ্গে এক হতে পারছে না। মাদ্রাসায় এখনো জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে না। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। মূল শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তন যদি না আনা হয় ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে।
No comments:
Post a Comment