রাজধানীতে ১৩ চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এগুলোর তদন্তেও কোনো অগ্রগতি নেই। গ্রেফতার হয়নি এসব খুনের আসামিরা। সন্দেহজনক হিসেবে দু-একজন গ্রেফতার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে খুনিরা। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতায় কোনো কোনো আসামি বিদেশে পালিয়ে গেছে। আবার খুনিরা প্রভাবশালী হওয়ায় দেশে থাকলেও ধরা পড়ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে ভুক্তভোগীদের। তবে পুলিশ বলছ
ে, শুধু খুন নয়, সব ধরনের অপরাধীকে গ্রেফতারে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় বেশির ভাগ হত্যার রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতিবিদদের ঢালাও মন্তব্য মামলার তদন্তে বিঘœ ঘটায়। ফলে সমাজে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্প্রতি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। পেশাদার খুনিদের পাশাপাশি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় খুনের ঘটনা ঘটছে। অপরাধীদের ব্যাপারে দুর্বল আইনি ব্যবস্থা আর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে ব্যক্তিগত টার্গেট এবং পারিবারিক ও সামাজিক ছোটখাটো দ্বন্দ্বের জেরেও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকানো অনেকটাই দুষ্কর। জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর ১৭৪ নম্বর পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় ঢুকে স্ত্রী ও স্বজনদের বেঁধে আটকে রেখে চ্যানেল আইয়ের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। ওই রাতেই ছেলে ফয়সাল ফারুকী বাদি হয়ে অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। ফারুকীকে খুন করে বাসা থেকে ছয় লাখ তিন হাজার টাকা লুট হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। পরে এই মামলা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। সন্দেহজনক হিসেবে এক নারীসহ তিনজনকে আটক করা হলেও কার্যত তাদের কাছ থেকে হত্যার কোনো কুই পায়নি গোয়েন্দারা। শনিবার পর্যন্ত এ খুনের ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম বলেন, এখনো ফারুকী হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটন করা যায়নি। এর আগেও একই রকমভাবে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এগুলোর ধরন যেহেতু একই রকম সেহেতু কোনো সঙ্ঘবদ্ধ গ্রুপ বা ভাড়াটে খুনিরা এই খুন করছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে মামলার তদন্তে বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই বলে দাবি করেন ডিসি নাজমুল। তিনি বলেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর ইসলামী ছাত্রসেনার পক্ষ থেকে আদালতে একটি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলায় কোর্টের আদেশ পেয়েছি তবে এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। ফারুকী খুনের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই পরদিন ২৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাজধানীর মগবাজারে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। নিহতদের একজন নারী। ওই ঘটনার মূল হোতা কাইল্যা বাবু অর্থাৎ কালা বাবু পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয়। ঘটনায় জড়িত অন্য খুনিরা এখনো ধরা পড়েনি। উদ্ধার হয়নি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রও। তিন খুনের ঘটনার কয়েক মাস আগে কালা বাবু মগবাজারে এক আনসার সদস্যকেও গুলি করে হত্যা করেছিল বলে জানা যায়। এ মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, মগবাজারের ট্রিপল মার্ডারের ১৫ জন এজাহারভুক্ত আসামি ছিল। এদের মধ্যে ঘটনার পরপরই চারজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়। এ ছাড়া সোমবার ভোরে প্রধান অভিযুক্ত কালা বাবু পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এ সময় তার আরো দুই সহযোগী রাজিব হাসান ও আল আমিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের সময় কালা বাবুও তাদের সাথে ছিল। তবে কেন তাদের হত্যা করা হয়েছে সে ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি পুলিশ। তিনি দাবি করেন, মামলার অগ্রগতি অনেকটাই এগিয়েছে। অভিযুক্ত অন্য আসামিদের গ্রেফতার এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের গোড়ানে সন্ত্রাসীরা বাবা ও ছেলেকে গুলি করে ৪৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ঘটনায় ছেলে সায়েম নিহত হন। তার বাবা হাসপাতালে এখনো আশঙ্কায় রয়েছেন। এ ঘটনায় কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে ওই রাতেই প্রত্যাহার করা হয় খিলগাঁও থানার ওসি সিরাজুল ইসলামকে। ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করা গেলেও জড়িত অন্যরা রয়েছে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়া ৪৮ লাখ টাকারও হদিস মেলাতে পারেনি পুলিশ। গত ৯ আগস্ট দলীয় কোন্দলে রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা জাহাঙ্গীর কবিরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। এই ঘটনায় র্যাব কু উদঘাটন এবং এক মহিলাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। তবে এখনো রহস্য উন্মোচন হয়নি। গত ২৯ মে রাজধানীর মতিঝিলে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার সুলতান আহমেদকে। ঠিকাদারি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে কৃষক লীগ নেতা আফজাল হোসেন তাকে খুন করেছেন বলে পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাকাণ্ডের কোনো আসামি ধরা পড়েনি। মামলার বাদি নিহতের চাচাতো ভাই ফরিদ হোসেন অভিযোগ করেন, খুনে জড়িত আফজাল হোসেন বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সরকারি দলের নেতা হওয়ায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে না। তবে গোয়েন্দারা বলছে, আফজাল হোসেন বিদেশে পালিয়ে গেছে। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর রাজধানীর গোপীবাগের ৬৪/৬ নম্বর বাড়ির দোতলায় খুন হন কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক ওরফে মনি, লুৎফরের অনুসারী মঞ্জুরুল আলম, রাসেল, শাহীন ও মজিবুর সরকার। এ ঘটনায় লুৎফর রহমানের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করে ওয়ারী থানায় মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। ডিবি পুলিশ বলছে, নিহত লুৎফর রহমান ইমাম মাহদী (আ:)-এর নাম ব্যবহার করে ধর্মীয় বিভিন্ন ‘বিভ্রান্তিকর’ মতবাদ প্রচার করতেন। কখনো কখনো নিজেকে ইমাম মাহদী বলেও দাবি করতেন। এভাবে ৯ মাসেও উপরি উক্ত ছয়টি হত্যাকাণ্ডের রহস্যের কূলকিনারা না হওয়ায় নিহতদের পরিবারের মধ্যেও শঙ্কা বিরাজ করছে। আতঙ্কে এসব পরিবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নিহত লুৎফর রহমানের ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, তারা এ মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশ। কারা এ হত্যায় জড়িত সেটিই শনাক্ত করতে পারেনি পুুলিশ। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মামলার তদন্তে বলার মতো কোনো অগ্রগতি নেই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মাদক ব্যবসায়, জমি দখল, বাড়ি দখল, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, ব্যবসায়িক বিরোধ, পারিবারিক কলহ, প্রেম-পরকীয়া, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসহ আরো নানা কারণে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে। যারা খুন করছে তাদের একটি বড় অংশই প্রত্য ও পরোভাবে মতাসীন দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকছে। ফলে খুন করেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে স্বজনহারাদের অভিযোগ। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ের থানা পুলিশ অতিমাত্রায় দলবাজিতে জড়িয়ে পড়ায় তারা ঠিকমতো কর্তব্য পালন করছে না। তাদের কর্মকাণ্ড তদারকিতেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপরে বিরুদ্ধে একরকম অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার অগ্রগতি না হওয়ার ব্যাপারে অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত এসব হত্যাকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় আইনশৃঙ্খলার অবনতি দিন দিন বাড়ছে। আমাদের দেশে পুলিশ প্রশাসনে অনেক দক্ষ ব্যক্তি রয়েছেন। তবে এদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয় বলে তারা মামলার তদন্তে মন দিতে পারেন না। তিনি বলেন, অনেক ঘটনার রহস্য পুলিশ উদঘাটন করে থাকে। তবে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সংঘটিত কোনো ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারে না পুলিশ, যার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বেড়ে যায় অপরাধপ্রবণতা। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা আর দক্ষতার অভাবে অপরাধীরা ধরা পড়ে না। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ঢালাও মন্তব্য মামলার তদন্তে বিঘœ ঘটায়। তিনি দাবি করেন, যদি পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করা হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং এসব চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের দ্রুত সুরাহা হবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী পরিচালক আবুল বাশার বলেন, পুলিশকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। এ কারণে অনেক পুলিশ মাঠে ঠিকমতো কাজ করছে না। এতে খুন করেও অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলেই কেবল অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। তিনি বলেন, অসংখ্য ঘটনা আছে যা কিছু দিন পর মানুষ ভুলে যায়। এ সুযোগে পুলিশ ও সরকার সেসব ঘটনার রহস্য উন্মোচনে কম গুরুত্ব দেয়। একসময় ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। আর এই সুযোগই নেয় অপরাধীরা। তারা অন্য একটা অপরাধ করতে ভয় পায় না। ঢাকা মহানগর পুলিশ মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মাসুদুর রহমান জানান, প্রতিটি হত্যাকাণ্ড পুলিশ তদন্ত করে আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করছে। যেসব ঘটনায় আসামি এখনো গ্রেফতার হয়নি তাদের গ্রেফতারে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
No comments:
Post a Comment