সংগ্রামের শুরুটা ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি। বিপথগামী সেনাদের হাতে স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক নেতা। তখন এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আপসহীন আন্দোলনই তাকে নিয়ে আসে লাইমলাইটে। নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন, অনমনীয় সংগ্রাম, বারবার কারাবরণও খালেদা জিয়াকে টলাতে পারেনি। সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন সম্মুখপানে। ২০০৭ সালে খালেদা
জিয়ার সংগ্রামী সেই অনমনীয় মনোভাবের প্রকাশ ঘটে এক অনাকাক্সিত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কারাবরণের পর। সেনা সমর্থিত এক-এগারোর সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেনÑ‘বাংলাদেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। কোথাও যাবো না, দেশের মাটি কামড়েই পড়ে থাকব।’ ২০০৯ থেকে ২০১৪, পাঁচ বছর কেটেছে নানামুখী চাপ আর প্রবল আন্দোলনমুখরতায়। বিগত ৫ জানুয়ারি ‘বিরোধী দলবিহীন’ নির্বাচনের পর নতুন করে আবার সংগ্রাম শুরু করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আজ ১১ সেপ্টেম্বর। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ‘সেনাসমর্থিত তথাকথিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে চতুর্থবারের মতো গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া। এক বছরেরও বেশি সময় কারাবন্দী থেকে এই দিনে মুক্তি পান তিনি। বিএনপি ২০০৯ থেকে এই দিনটিকে খালেদা জিয়ার ‘কারামুক্তি দিবস’ হিসেবে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। সংগ্রামী জীবনের সূচনা ও আপসহীন নেত্রী : ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হন। তখন থেকে বিএনপির মধ্যে চাপ সৃষ্টি হয় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিমুখী করার। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। এর মাস দুই পরেই সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলন খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসে সম্মুখ নেতৃত্বে। ১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটি সাতদলীয় জোট গঠন করে এবং জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম শুরু করে। ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রমনার বটমূলে প্রথম জনসভায় ভাষণ দেন খালেদা জিয়া। একই বছরের ২৭ নভেম্বর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভীত হয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার প্রথমবারের মতো তাকে গ্রেফতার করে। বিচারপতি সাত্তার রাজনীতি থেকে অবসর নিলে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া মনোনীত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন। একই বছরের ১ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন হন। খালেদা জিয়া ৯ বছরব্যাপী আন্দোলনে এরশাদের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক শাসনের সাথে কোন আপস করেননি। অন্য রাজনৈতিক দল সমঝোতা করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যায়নি। তিনি হয়ে ওঠেন আপসহীন নেত্রী। এরশাদের শাসনামলে খালেদা জিয়া দুইবার গ্রেফতার হন এবং একবার তাকে গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৮৩ সালের ২৭ নভেম্বর প্রথমবার, ১৯৮৪ সালের ৩ মে দ্বিতীয়বার এবং ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গৃহে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এরশাদবিরোধী আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। প্রেসিডেন্ট এরশাদ বাধ্য হন পদত্যাগের ঘোষণা দিতে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া দুইবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। জানুয়ারি ১৯৯১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৮Ñ এ সুদীর্ঘ ১৮ বছরে মোট পাঁচটি সাধারণ নির্বাচনে যে সর্বোচ্চ ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব ছিল তার সব কয়টিতেই খালেদা জিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সব ক’টিতে বিজয়ী হন। খালেদা জিয়ার প্রাপ্ত ভোট ২৫ লাখের বেশি। বাংলাদেশই আমার একমাত্র ঠিকানা : ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর ঢাকার রাজপথে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত মইন-ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতা নেয়। আর এরপর থেকেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে থাকা বিএনপির ওপর চালানো হয় স্টিম রোলার। সেনাসমর্থিত সরকার তখন রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে বিদায় করতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের নানামুখী চেষ্টা চালায়। খালেদা জিয়ার ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়, যাতে তিনি বিদেশে চলে যান। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের ওই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন খালেদা জিয়া। তিনি দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেনÑ বাংলাদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন এবং তার একমাত্র ঠিকানা বাংলাদেশ। ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন সরকারের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষার জন্য সেনাসমর্থিত ওই সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালের এই দিনে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়। মোট এক বছর এক সপ্তাহ জেলে বন্দী ছিলেন তিনি। চলছে কঠিন সংগ্রাম : মইন-ফখরুদ্দীনের তড়িঘড়ির নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও একনিষ্ঠ গণতন্ত্রকামী হিসেবে খালেদা জিয়া ওই নির্বাচনে অংশ নেন। তখনো বিএনপির বহু নেতা ছিলেন জেলে। অনেকে ছিলেন পালিয়ে। যারা মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের পাল্লায় পড়ে সংস্কারপন্থী হয়েছিলেন, তারা বিএনপিতে ফিরতে বিব্রত বোধ করছিলেন। বিএনপি তখন ছিল বিশৃঙ্খল ও হতোদ্যম। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে খালেদা জিয়া ১৪ দিনে ১০ হাজার কিলোমিটার পথ সফর করলেও পূর্বানুমান অনুযায়ী নির্বাচনে বিএনপির শোচনীয় পরাজয় হয়। সেই পরাজয়ের বৃত্ত থেকে দলকে বের করে আনতে শুরু হয় খালেদা জিয়ার নতুন লড়াই। গুলশানে নিজস্ব অফিস থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পার্টি পুনর্গঠন ও পুনর্জীবন সঞ্চারের কাজ শুরু করেন তিনি। ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় দলের পঞ্চম কাউন্সিল। ওই কাউন্সিল ছিল সুপরিকল্পিত ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির অভূতপূর্ব বহিঃপ্রকাশ। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল রোডে ৪০ বছর ধরে ব্যবহৃত বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়। স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে তিনি তার দুই পুত্র, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনী নিয়ে বসবাস করতেন। ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া গুলশানে একটি ভাড়াবাড়িতে থাকছেন। অদম্য খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত দুঃখ ও শারীরিক অসুবিধা উপেক্ষা করে তারপর থেকে বিএনপির সাংগঠনিক কাজে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ তুলে দেয়ার পর খালেদা জিয়ার দল বিএনপি আবারো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। নির্দলীয় সরকার বহালের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। রোড মার্চসহ ঢাকায় জনসভা সব কিছুতেই ব্যাপক সাড়া মেলে। ২০১৩ সালে নির্দলীয় সরকার বহালের দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়। লাগাতার হরতাল-অবরোধ চলে অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর জুড়ে। কিন্তু বিএনপির দাবি না মেনেই সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছাড়াই দেশজুড়ে ব্যাপক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি এই নির্বাচনকে অবৈধ ও প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সংগ্রাম নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাজনৈতিক সংগ্রামের এপর্যায়ে এসে ব্যক্তিগত জীবনে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন তিনি। এখন তার বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে পাঁচটি মামলা চলছে। তার পরিবারের অপর দুই সদস্য তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৭টি এবং ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে। শুধু তাই নয়, তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকেও তার সাথে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার পুরো পরিবারকে মামলার জালে আটকে ফেলা হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে দলের সব শীর্ষ নেতা ও হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে চলছে মামলা। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত আরেকটি নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট। বিএনপি নেতারা বলছেন, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার এই আন্দোলনে অনমনীয় ও অনিবার্যভাবেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন : মির্জা ফখরুল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং জনগণের অধিকারের প্রশ্নে লড়াই করে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংগ্রামে শামিল হতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার সপ্তম কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে গতকাল এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়ার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে নিহত করার পর ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনগণের কেড়ে নেয়া অধিকার পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে শহীদ জিয়ার জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রের রাজনীতির পতাকাকে উড্ডীন করে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, সেই থেকে তিনি এই দেশে সব অগণতান্ত্রিক দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই অব্যাহত রেখেছেন এবং জনগণ তাকে ‘আপসহীন’ নেত্রীর অভিধায় অভিষিক্ত করেছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়ার অবিচল সংগ্রাম চক্রান্তকারী কোনো শক্তিই তাকে পরাভূত করতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment