দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা বলেছেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধান সংশোধনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের আজ্ঞাবহ করার একটা অশুভ প্রচেষ্টা এই সংশোধনী। তবে তারা বলেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি সত্যিকারের পার্লামেন্টে এই ক্ষমতা গেলে সমস্যা নেই। সে ক্ষেত্রে অপসারণ প্রক্রিয়াটি আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। গতকাল নয়া দ
িগন্তের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধান সংশোধনীর খসড়া ক্যাবিনেট অনুমোদন দিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে সংসদীয় কমিটিও তা অনুমোদন দেবে। তিনি বলেন, সরকার সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করেছে। এর ফলে সাংবাদিকেরা এখন সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। একইভাবে বর্তমানে অনির্বাচিত একটি সংসদের আওতায় যদি বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয়, সেই ক্ষেত্রে বিচারকরা একইভাবে আতঙ্কিত থাকবেন। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। কেননা, বিচারকালে তাদের মনে সবসময় একটা ভীতি থাকবে, যাতে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা তাদের বিরাগভাজন না হয়। মোট কথা, উচ্চ আদালতের বিচারকগণকে চাপের মুখে কাজ করাতে বা আজ্ঞাবহ করার একটা অশুভ প্রচেষ্টা এই সংশোধন। রফিক-উল হক সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে এসেছে, ভালো। কিন্তু বাংলাদেশে যে পার্লামেন্ট, তাতে এই ক্ষমতা পার্লামেন্টে না যাওয়াই ভালো। এখানে ১৫৪ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়েছেন। এটাতো পার্লামেন্ট না। যদি সত্যিকার পার্লামেন্ট হয়, তাদের হাতে ক্ষমতা গেলে দোষ নেই। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সংসদ সদস্য দলের বাইরে ভোট দিতে পারেন না। এখানে প্রধানমন্ত্রী যদি বলেন, ভোট দেন, তাহলে সবাই ভোট দেবে। যদি জনগণের ভোটে সত্যিকারের পার্লামেন্ট গঠিত হয়, তাহলে তো সমস্যা নেই। সেটা হতে হবে তো। সিনিয়র এই আইনজীবী আরো বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয় মেনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো পার্লামেন্টে যদি কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা হয় তাহলে সমস্যা হবে না। কারণ, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মতে- জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। শফিক আহমেদ সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণ বিষয়ে যে বিধানগুলো ছিল তা ফিরে আসবে। পার্থক্য কেবল- ’৭২-এর সংবিধানে বিচারপতিদের বয়স ৬২ বছর ছিল, এখন ৬৭ বছরের কথা বলা হয়েছে। যে বিধানটি আনা হচ্ছে তাতে বলা হয়েছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কথা। যদি তা প্রমাণিত হয় তাহলেই কেবল কোনো বিচারপতিকে অপসারণের জন্য সংসদে প্রস্তাব করা হবে। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য তা অনুমোদন করলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তা রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। তিনি বলেন, যেহেতু অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার শর্ত আছে এবং তা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, তাই এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি দাবি করেন, সংবিধানের এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবস্থান বরং আরো শক্তিশালী হলো। কারণ, অসদাচরণ প্রমাণিত হলেও সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুমোদন না দিলে কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে মাত্র তিনজনের একটি বডি তদন্ত করে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারতেন। তাই ’৭২-এর বিধানে তাদের রক্ষাকবচ আরো বেশি হচ্ছে। আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল ইসলাম বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, একটি আইন করা হবে। অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে বিষয়ে সেই আইনে বলা থাকবে। অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি বডি থাকবে। তদন্তে অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণিত হলেই কেবল তা সংসদে যাবে। প্রক্রিয়াটি এমনভাবে করা হলে তা ভালো হবে। তিনি আরো বলেন, সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতি সম্ভাব্য তদন্ত কমিটির প্রধান হতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন আইনমন্ত্রী। কিন্তু বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বা তার মতো কোনো ব্যক্তি যদি এই কমিটির প্রধান হন তাহলে সমস্যা হবে। কারণ, তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত একজন লোক। তাকে এমন একটি সংস্থার প্রধান করা হলে অনেক মামলায় বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে কখনো বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। এমন আশঙ্কা থেকে যায়। আইনের এই অধ্যাপক আরো বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থনের কথা বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি কোনো সংসদে এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে, তাহলে তদন্তকারীরা কোনো বিচারকের অসদাচরণের দালিলিক প্রমাণ পেলেও তাকে অপসারণ করা যাবে না। তাই এমন প্রস্তাব ষড়যন্ত্রমূলক হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। কিন্তু এটাতো প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ। তাই দুই-তৃতীয়াংশের কথা বলাটা আইওয়াশ হতে পারে। এ দিকে বিচারপতিদের অপসারণের মতা সংসদে ফিরিয়ে আনা হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে বলে মন্তব্য করে গত রোববার এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন দেশের চার বিশিষ্ট আইনজীবী। তারা হলেনÑ ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ। যৌথ বিবৃতিতে এই চার আইনজীবী বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি। আমাদের সর্বোচ্চ আদালত অষ্টম সংশোধনীসংক্রান্ত দেয়া যুগান্তকারী রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কোনো আলোচনা, বিতর্ক বা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন ছাড়াই হঠাৎ কেন সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব আনা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একজন বিচারপতিকে অপসারণের েেত্র আইনপ্রণেতারা নিরপে অবস্থানে থাকতে পারেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট এই চার আইনজীবী। তারা বলেন, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য দলের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে সংসদে বিচারপতিদের অপসারণ করা হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। এই চার আইনজীবী বিচারপতিদের অভিশংসনসংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনের আগে জাতীয় ঐকমত্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, একমাত্র সঠিক আলোচনার পরই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল-২০১৪ গত রোববার সংশোধিত আকারে সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। বিলে বিচারকদের অপসারণের মতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে সংসদের কাছে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উত্থাপনের পর বিলটি সাত দিনের মধ্যে পরীা-নিরীা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তা আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
No comments:
Post a Comment