‘নির্বাচন এলে গায়ে-গতরে খেটে এমপি বানায় কর্মীরা। যেই উনারা এমপি বনে যান, অমনি দূরে ঠেলে দেন খাটা-খাটনি করা কর্মীদের। নিজস্ব বাহিনী হয়ে যায় এমপি সাহেবদের। মন্ত্রীদের বেলায়ও তাই। কর্মীদের কাছে এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত। তাই দলে অনৈক্য-অসন্তোষ।’ এ মন্তব্য নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাজেদুর রহমান খানের। তাঁর জেলার দুটি উপজেলা বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুরে নেতা-কর্মীদের ভেতরে চরম অসন্তোষ ও অনৈক্য চলছ
ে বলেও জানান তিনি। সাজেদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ অনৈক্য-অসন্তোষের জন্য একমাত্র দায়ী স্থানীয় এমপি। তাঁর কাছে নেতা-কর্মীরা অতি তুচ্ছ।’ নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মমতাজুল ইসলাম বলেন, ‘নীলফামারী-৩ আসনের এমপি অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা মনে করেন, তাঁর কতৃত্বেই চলবে এখানকার সংগঠন। তিনি এমপি তাই তাঁর কথায় উঠবোস করবে সবাই। কিন্তু তাঁর কর্তৃত্ব মানতে নারাজ এখানকার নেতা-কর্মীরা। ফলে বিশেষ করে জলঢাকা উপজেলার রাজনৈতিক চিত্র খুবই করুণ। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভেতরে চরম অনৈক্য-অসন্তোষ বিরাজ করছে।’ জেলার আরেক উপজেলা কিশোরগঞ্জের সাংগঠনিক চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ উপজেলায় দলের সভাপতি এশরারুল হক ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বাবুলের মধ্যে দলাদলি চরমে। সভাপতি একটা বলেন তো সাধারণ সম্পাদক আরেকটা।’ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে এ চিত্র শুধু দুই জেলায়ই নয়, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত একই অবস্থা। অনৈক্য আর অসন্তোষ জেঁকে বসেছে দলটির ভেতরে। এতে সারা দেশে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট দলীয় এমপি, এমপির ওপর ক্ষুব্ধ জেলার নেতারা, আবার তাঁদের ওপর চটা নিচের দিকের দলীয় লোকজন। একই অবস্থা থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়েও। বিভিন্ন স্তরে কোন্দল আর অসন্তোষের কারণে বিভিন্ন সময়ে সাংগঠনিক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। দলের কেন্দ্র থেকে কয়েক দফায় তৃণমূল সংগঠনের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি। নানা অজুহাতে পরে ঘোষিত কর্মসূচিগুলো স্থগিত করতে হয় আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একাধিক সদস্য ও কয়েকজন সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা দলের কেন্দ্রীয় নেতা, কিন্তু সচিবালয়ে মন্ত্রীদের কাছে কোনো কাজে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় তাঁদের। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে যেটুকু সম্মান পাওয়ার কথা সেটুকু তাঁরা পান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘গত মাসে এক প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় আমাকে বসে থাকতে হয়েছে। এ ধরনের আচরণে মানিসকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মঈনউদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের দলের এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব। উচ্চপদ পেয়ে গেলে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় না দিনের পর দিন। ফলে নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়। মানসিকভাবে দুর্বলও থাকে।’ অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, ‘এমপি সাহেবরা নিজস্ব বলয় তৈরি করে দলে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। তাঁদের কারণে মাঠের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ।’ তিনি জানান, তাঁর জেলায় দলের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৪ সালে। নিয়মিত সম্মেলন না হওয়ায়ও সংগঠনে সংকট সৃষ্টি হয় বলে দাবি করেন তিনি। পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান মোশাররফ হোসেন বলেন, দলীয় এমপিদের বলয় নতুন নয়। আর এ বলয় আওয়ামী লীগকে বারবার বেকায়দায় ফেলে। নীলফামারীর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মমতাজুল ইসলাম বলেন, ‘দলের কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই সমন্বয় নেই। কর্মী-সমর্থকদের মূল্যায়ন নেই। মোবাইল ফোনেই এখন রাজনীতি হয়। কারো সঙ্গে কারোর দেখা হয় না। এ ছাড়া মন্ত্রী-এমপিরা দায়িত্ব নিয়ে পরে আর জেলা-উপজেলায় যান না। এসবই অনৈক্য-অসন্তোষের কারণ।’ তিনি আরো বলেন, সবার সঙ্গে সবার ঘন ঘন বসতে হবে। বসলেই সব অনৈক্য-অসন্তোষ ও বৈরিতা দূর হয়ে যাবে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, অনৈক্য-অসন্তোষের বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও জানা। তাই দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বক্তৃতায় ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু উদ্যোগের অভাব। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের সব জেলায়ই আওয়ামী লীগে দুই-তিনটি করে এমনকি কোথাও কোথাও এরও বেশিসংখ্যক উপদল আছে। উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়েও এ ধারা বিদ্যমান। কেন্দ্রেও সমন্বয়হীনতা, অসন্তোষ : জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়েও সমন্বয়ের অভাব। কেউ কাউকে পাত্তা দেন না বলে অভিযোগ আছে। বয়সে প্রবীণ ও ঊর্ধ্বতন অনেক নেতাকে মান্য করেন না কোনো কোনো নবীন নেতা। বরং অসম্মান করার মানসিকতাও কাজ করে। এ কারণে দলের অনেক সিনিয়র নেতার দলীয় কর্মসূচি বর্জন করার ঘটনাও ঘটেছে। দলের একাধিক সিনিয়র নেতা অভিযোগের সুরে বলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে দল ক্ষমতায় আসার পর অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে মন্ত্রী না করে বরং বয়সে ও রাজনীতিতে নতুন অনেককে মন্ত্রী করায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। ভারতের উদাহরণ দিয়ে ওই নেতারা বলেন, নরেন্দ্র মোদি যে সরকার গঠন করেছেন তাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। শুধু বাংলাদেশেই এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। আবার যেসব কেন্দ্রীয় নেতা সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি তাঁরাও অসন্তুষ্ট। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যাঁরা মন্ত্রী হয়েছেন তাঁরাও অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের পাত্তা না দেওয়ায় অনৈক্য-অসন্তোষ বেড়েছে। এসব কারণে সাংগঠনিক কাজকর্ম নিয়েও নেতাদের মধ্যে আগ্রহের কমতি দেখা যায়।
No comments:
Post a Comment