উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে বহুল আলোচিত ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। বাহাত্তর সালের সংবিধানে এই ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রবিবার জাতীয় সংসদে বিলটি উত্থাপনকালে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সদস্যরা হাত তুলে বিলের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানান। বিলটি পাস হলে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্র
ী ও স্পিকারের পর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদেরও অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদ ফিরে পাবে বলে মন্ত্রী দাবি করেছেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে বিলটি উত্থাপনকালে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধী দলের বেশির ভাগ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তবে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ছিলেন অনুপস্থিত। সংসদে উত্থাপনের পর বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে সংসদীয় কমিটিকে। চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাস হওয়ার কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের বিধান ছিল। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটিই আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। পাশাপাশি বাদ পড়ছে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে প্রণীত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের নিয়মটি। তবে বিলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবে। জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত এই বিলটি পাস হওয়ার পর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আলোকে তিন মাসের মধ্যে আরেকটি নতুন আইন করা হবে। এতে অভিযুক্ত বিচারকের অপসারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা থাকবে। বিচারকদের অসামর্থ্য, অসদাচরণ ও অভিযোগ সম্পর্কে কিভাবে তদন্ত হবে, সংসদ কিভাবে প্রস্তাব নেবে এবং রাষ্ট্রপতি কোন প্রক্রিয়ায় তা অনুমোদন করবেন, এসব বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে সেই আইনে। বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ-সংবলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগের কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতিকে সংসদ কর্তৃক অভিশংসনের মাধ্যমে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৫২), সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ (অনুচ্ছেদ ৫৭), সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমে স্পিকারকে অপসারণ (অনুচ্ছেদ ৭৪) এবং সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত প্রস্তাবের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের বিধান (অনুচ্ছেদ ৯৬) ছিল।’ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে যথাক্রমে অভিশংসন, পদত্যাগ ও অপসারণ সম্পর্কিত পূর্ববর্তী বিধান এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলেও সামরিক শাসকের মাধ্যমে অসাংবিধানিক পন্থায় সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে অভিযোগে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পরিবর্তনক্রমে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্য দুজন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়, যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠিত সংসদে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মতো উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহিতার নীতি বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে।’ এতে আরো বলা হয়, ‘এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৭ এর চেতনা পুনর্বহালের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন-২০১৪ এর বিল উত্থাপন করা হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধির পাশাপাশি জনপ্রতিনিধির কাছে তাঁর জবাবদিহিতা থাকা সংক্রান্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত থাকবে।’ নতুন যা যুক্ত হচ্ছে : সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬-এর নতুন সংশোধনী বিলটির (১) ধারায় বলা হয়েছে, “এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে কোন বিচারক সাতষট্টি বৎসর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। (২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিবেন। এ ছাড়া (৪) ধারা অনুযায়ী, কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।” নবম সংসদেও বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। ২০১১ সালে এ বিষয়টি উঠে আসে। পরের বছর তৎকালীন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। তখন থেকেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশ করলেও অজানা কারণে তখন এই সংশোধনী আনা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক ফরমান বলে ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করা হয়। এটি করা হয়েছিল জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে ১৯৭৮ সালে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সংবিধানেও বিচারক অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে। আইনমন্ত্রীর দাবি, বিচারকদের স্বাধীনতা এক বিন্দুও ক্ষুণ্ন হবে না : আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হলে বিচারকদের স্বাধীনতা এক বিন্দুও ক্ষুণ্ন হবে না। তিনি বলেন, ‘বিচারপতিদের রায়ের সাথে অভিশংসনের কোনো সম্পর্ক নেই। রায়ের জন্য তাঁরা অভিশংসনের মুখোমুখি হবেন না।’ জেলা ও দায়রা জজ সমপর্যায়ের বিশেষ জজ ও জুডিশিয়াল কর্মকর্তাদের এক প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মন্ত্রী। গতকাল বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (জেটি) সম্মেলন কক্ষে সপ্তাহব্যাপী এ প্রশিক্ষণ কোর্স উদ্বোধন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী ছাড়াও জেটির মহাপরিচালক বিচারপতি খন্দকার মুসা খালেদ এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিব (দায়িত্বপ্রাপ্ত) আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক বক্তৃতা করেন। আইনমন্ত্রী বলেন, বড় ধরনের অসদাচরণ ও অযোগ্যতার অভিযোগ প্রমাণিত হলেই কেবল সংশ্লিষ্ট বিচারপতি অভিশংসনের সম্মুখীন হবেন। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে অভিসংশন বিল পাস হওয়ার পর এ বিষয়ে আইন করা হবে। অভিশংসনের অপব্যবহার যাতে না হয়, সেভাবেই আইন করা হবে।
No comments:
Post a Comment