Monday, October 27, 2014

দুহাতে লুটেপুটে খাচ্ছেন সুনামগঞ্জের রেজিস্ট্রার:যুগান্তর

সুনামগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রি ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলো ঘুষের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এখানে ইচ্ছেমতো দলিল সম্পাদন হয়। মামলা করেও অনিয়মের লাগাম টানা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। জাল দলিলের মাধ্যমে কে কখন কার জমি দখল করে সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন সুনামগঞ্জের মানুষ। আর জেলা রেজিস্ট্রার যেন হাতে পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ। এর বদৌলতে রাজধানীতে
একাধিক বাড়ি, গাড়ি, দোকানপাটসহ গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম আর রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার ঘটনা যত বেশি সুনামগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রারের উপরি আয়ও তত বেশি। জেলার বিভিন্ন উপজেলার সাবরেজিস্ট্রাররা কিছু অসাধু দলিল লেখক, অফিস সহকারী, মোহরার, নকলকারকদের সহায়তায় ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন, জাল পর্চা, ছবি পরিবর্তন, নাবালকের দলিল সম্পাদন, দলিলে ঘষামাজা, জন্ম নিবন্ধন সনদবিহীন দলিল সম্পাদনের জন্য আদায় করেন মোটা অংকের অর্থ। বিভিন্ন হারে আদায় করা এ ঘুষের টাকার একটা বড় অংশ পাচ্ছেন জেলা রেজিস্ট্রার। এক লন্ডন প্রবাসী মহিলার স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অংকের ঘুষ পেয়ে নন-এনকামব্রেন্স সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার সাহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বরে সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দুর্নীতির অভিযোগে একটি মামলা করা হয়। এরপরও জেলা রেজিস্ট্রারের সীমাহীন দুর্নীতি থামেনি। বিশ্বম্ভরপুর, দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার বাদশাগঞ্জসহ ১১টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রেও অনিয়মকে পুঁজি করে বিভিন্ন হারে রমরমা ঘুষবাণিজ্য চলছে। এরমধ্যে দলিলদাতা ও গ্রহীতার জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকলে উভয়ের জন্য ৫০০ টাকা করে, নামজারির কাগজপত্র না থাকলে ২ হাজার টাকা, ভুয়া পর্চায় ১ হাজার টাকা, দাগ নং ভুল হলে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা হলে ২০ হাজার টাকা, কমিশন দলিলে ১০ হাজার টাকা, নাবালকের দলিলে ৫ হাজার টাকা, দানপত্র দলিলে ১০ হাজার টাকা, হেবা দলিলে ২০ হাজার টাকা, খাজনার রশিদ না থাকলে ২ হাজার টাকা, নকল তুলতে ৫০০ টাকা, অফিস বন্ধের দিন দলিল করলে ৫ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়ে দলিল সম্পাদনের ঘটনা সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে অহরহ ঘটছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাবরেজিস্ট্রার স্বীকার করেছেন, প্রতিটি দলিলের জন্য রেজিস্ট্রার সাহিদুজ্জামানকে ৮০ টাকা করে দিতে হয়। একই দলিলগুলোর ওপর ৬ মাস পরপর সাবরেজিস্ট্রি অফিস পরিদর্শনে গেলে ওই সময় তাকে দিতে হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। সঙ্গে ভুরিভোজের আয়োজন, বড় মাছসহ অতিথি পাখিও কিনে দিতে হচ্ছে রেজিস্ট্রারকে। এমনকি তার সফরসঙ্গী মোহরার শ্যামাপদ সরকারকেও রেজিস্ট্রারের নির্দেশমতো ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। দুর্নীতির দায়ে শ্যামাপদ সরকারকে শাল্লায় শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও কিছুদিনের মধ্যে রেজিস্ট্রার সাহিদুজ্জামানের সহযোগিতায় আবার জেলা সদরে চলে আসেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি কমিশন দলিল বাবদ অতিরিক্ত ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা ঘুষ নেন রেজিস্ট্রার। নন-এনকামব্রেন্স সার্টিফিকেটের জন্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা, সব ক’টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সরকারি ভলিয়ম, কাগজপত্র, স্টেশনারি সরবরাহে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন দলিল লেখকের কাছ থেকে লাইসেন্সের বিনিময়ে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। দিরাই সাবেেরজিস্ট্রি অফিসের ৬ জন দলিল লেখকের জাল এসএসসি পাসের সনদের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন তাদের লাইসেন্স বাতিল করেন। কিন্তু জেলা রেজিস্ট্রার প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। আরও অভিযোগ পাওয়া গেছে, এক্সস্ট্রা মোহরার থেকে মোহরার পদে পদোন্নতির জন্য বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করেছেন রেজিস্ট্রার। জামালগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রার অফিসে দলিলে ঘষামাজার অভিযোগে এক অফিস সহকারীকে সাময়িক বরখাস্ত করার পর তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নেন রেজিস্ট্রার। জেলার যেসব উপজেলায় সাবরেজিস্ট্রারের পদ শূন্য রয়েছে সেখানে কেউ অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রথমেই রেজিস্ট্রারকে কমপক্ষে ৫০ হাজার এবং পরে প্রতি সপ্তাহে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেজিস্ট্রার অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, জেলার একটি উপজেলার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সাবরেজিস্ট্রারসহ সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে গত কয়েক মাস পূর্বে সাড়ে ৪৪ লাখ টাকার জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে জমির মূল্য প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা দেখিয়ে রাজস্ব বাবত মাত্র ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। অথচ দলিলগ্রহীতার কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে সাড়ে ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। বিষয়টি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন অফিসের নজরে এলে ঘটনা ধামাচাপা দিতে শেষ পর্যন্ত ওই জমির দলিল লেখকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক সময়ের কর্মচারী থেকে প্রথমে সাবরেজিস্ট্রার, পরে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পেয়ে সাহিদুজ্জামানে ধন-সম্পদ বেড়েছে রূপকথার গল্পের মতোই। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, খন্দকার সাহিদুজ্জামানের ঢাকা মহানগরীতে রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি। মতিঝিলে দোকানসহ শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার। ১৯৭৭ সালে এইচএসসি পাস করে সড়ক ও জনপথ বিভাগে সিকিউরিটি অফিসার পদে চাকরি নেন সাহিদুজ্জামান। পরে এরশাদ সরকারের আমলে এনাম কমিটির রিপোর্টে চাকরি হারানোর পর ১৯৮৫ সালে সিলেটের সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ বাগিয়ে নেন তিনি। সাবরেজিস্ট্রার থেকে রেজিস্ট্রার হওয়ার মধ্যে গত ২৮ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ২০০১ সাল থেকে ’০৩ সালের মধ্যে সাহিদুজ্জামান রাজধানীতে তৈরি করেছেন বাড়ি, কিনেছেন সুরম্য ফ্ল্যাট। এর মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ে ৪ নম্বও রোডের ৮৫/২ এর ৬ তলা একটি বাড়ি। লালমাটিয়ার ব্লক সিতে অক্সফোর্ড স্কুলের পেছনের হাউজ নম্বর ৫/১৩ এর সুরম্য ভবনেও তার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর একটিতে পরিবার নিয়ে থাকেন সাহিদুজ্জামান। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার মধুমিতা সিনেমা হলের কাছে অভিজাত লিলিপন্ড সেন্টারে স্ত্রীর নামে দুটি দোকান কিনেছেন সাহিদুজ্জামান। মিরপুর ১০ নম্বও থেকে ক্যান্টমেন্টের দিকে যেতে পানির ট্যাংকির পশ্চিম পাশের চার তলা একটি বাড়িরও মালিক তিনি। এসব দৃশ্যমান সম্পদের বাইরে আরও কোটি কোটি টাকার সম্পদ তার রয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। খন্দকার সাহিদুজ্জামান কিশোরগঞ্জে রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে ১ বছরের জন্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। এসব বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার সাহিদুজ্জামানের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। তবে রাজধানীতে তার নিজের তিনটি বাড়ি ও গাড়ি থাকার কথা যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেন তিনি। সাহিদুজ্জামান বলেন, বাড়ির একটি জমি আমার মায়ের, আরেকটি জমি ছিল বাবার। আরেকটি দানপত্রের জায়গা। মার্কেটের দোকান স্ত্রী কামরুন্নাহারের নিজের ব্যবসায়িক আয় থেকে কেনা হয়েছে। তবে স্ত্রী কি ব্যবসা করেন তা জানাতে পারেননি। দিরাই সাবরেজিস্ট্রার অফিসে ৪ জন দলিল লেখক তাদের সার্টিফিকেট জালিয়াতির কারণে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পরও কি করে এখনও দলিল লেখার কাজ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইজিআর অফিস থেকে তাদের পুনর্বহাল করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি কোনো টাকা নেননি বলে জানান।  

No comments:

Post a Comment