এমভি গাজীর পর এবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো মেরী এন্ডারসন। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা ডকইয়ার্ডে রহস্যজনক আগুনে এমভি গাজী পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়েছিল। রাতের আঁধারে কে বা কারা পেট্রল ঢেলে শতবর্ষী জলযানটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। পরে জানা যায়, গাজী স্টিমারটির মেরামত নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছিল। এ নিয়ে তদন্ত চলাকালে সেই দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই সাজানো অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গেলেও সেই রহস
্যের কিনারা হয়নি। গাজীর ‘খুনিরা’ শনাক্ত হয়নি। একই কায়দায় এবার আগুনে পুড়ল প্রায় শতবর্ষী জলযান মেরী এন্ডারসন। গত বৃহস্পতিবার রহস্যজনকভাবে জলযানের রেস্তোরাঁ ও পানশালায় আগুন লাগে। চোখের পলকে স্বপ্নের জলযানটি ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ বলেন নাশকতা, আবার কেউ বলেন বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে এই অগ্নিকাণ্ড। তবে বড় কথা হলো, কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এমনটা হয়েছে। একটি বেসরকারি কম্পানির কাছে ঐতিহাসিক জলযানটি ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। তাদের অসতর্কতাই মেরী এন্ডারসনের এমন পরিণতির জন্য দায়ী। মেরী এন্ডারসনে অগ্নিকাণ্ডের পর তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে স্টিমারে ভাসমান রেস্তোরাঁ অ্যান্ড বারের পরিচালক হক ট্রেডার্সের পক্ষে মো. সালাহউদ্দিন ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ইউনিট ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম দুটি সাধারণ ডায়েরি করেন ফতুল্লা থানায়। থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান জানান, প্রতিটি সাধারণ ডায়েরিতে অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হলেও এর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে হক ট্রেডার্সের পক্ষ থেকে ওই অগ্নিকাণ্ডকে নাশকতা বলে দাবি করে এর সঠিক তদন্ত দাবি করা হয়েছে। পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান অপরূপ চৌধুরী বলেন, ‘তদন্ত কমিটি সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিলেই আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তখন প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ বুড়িগঙ্গায় নোঙর করে আছে বার্ধক্যে জর্জরিত জাহাজ অস্ট্রিচ। ফতুল্লার বাসিন্দা মাসুদ আহমেদ জানান, ব্রিটিশদের হাতে গড়া জলযান মেরী এন্ডারসনের সঙ্গে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। পাকিস্তান আমলে ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ ওই জলযানে চড়ে বুড়িগঙ্গা ভ্রমণ করেছিলেন। বার্ধক্যে এসে সেই জলযান বুড়িগঙ্গায় স্থিতি পেয়েছিল রেস্তোরাঁ ও পানশালা হিসেবে। অবশেষে এখানেই সেই ইতিহাস আগুনের ফুলকিতে ছারখার হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত হয়তো তদন্ত কমিটি ও সাধারণ ডায়েরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে এ ঘটনা। এমভি গাজীর মতো প্রকৃত ঘটনা হারিয়ে যাবে কালের অতলে। বাংলাপিডিয়ার প্রধান সম্পাদক ও প্রবীণ ইতিহাসবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম জানান, ব্রিটিশ আমলে এটা ছিল বাংলার গভর্নরের বিলাসবহুল প্রমোদতরী। তৎকালীন গভর্নর স্যার জন এন্ডারসনের কন্যা মেরী এন্ডারসনের নামে এর নামকরণ করা হয় ‘স্টেট ইয়ট মেরী এন্ডারসন’। এটি ১৯৩৩ সালে কলকাতা শিপইয়ার্ডে এক লাখ ২৪ হাজার ৭০২ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। প্রমোদতরীটির দৈর্ঘ্য হলো ১৫০ ফুট, প্রস্থ ৩০ ফুট এবং উচ্চতা ১৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। পর্যটন করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে জলযানটি বাংলার লর্ড কিংবা গভর্নরের জন্য নির্ধারিত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়ে গেলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এতে যাতায়াত করতেন। স্বাধীনতার পর তা ব্যবহার করতেন দেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৮ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য মেরী এন্ডারসন পর্যটন করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেন। করপোরেশন একই সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নতুনভাবে সজ্জিত করে মেরী এন্ডারসন ভাসমান রেস্তোরাঁ ও বার হিসেবে ফতুল্লায় এটি স্থাপন করে। ২০০৫ সালের দিকে মেরী এন্ডারসন বেসরকারি কম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমভি গাজী ও মেরী এন্ডারসন ছাড়াও আরো কয়েকটি সরকারি ঐতিহ্যবাহী জলযান রয়েছে, যেগুলোর অবস্থাও করুণ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ শতবর্ষী এসব জলযান আগের মতো বনেদি আওয়াজ দিয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে আর পানির কলকল ধ্বনি তুলে নদ-নদীতে চলাচল করতে পারছে না। বরং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকে বিআইডাব্লিউটিসি দেখছে ‘অযথা হাতি পোষার’ দৃষ্টিতে। কিছুদিন আগে এলসিটি কুতুবদিয়া নামে এমন একটি জলযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এমভি সোনারগাঁও নামে আরেকটি জলযান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই নোঙর করে রাখা হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটে। বিআইডাব্লিউটিসির নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, বর্তমানে তাদের বহরে থাকা বেশির ভাগ জলযানের আয়ু শেষ হয়ে গেছে। জোড়াতালি দিয়ে সেসব সচল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। টিকে থাকা জলযানের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক হলো পিএস অস্ট্রিচ ও পিএস মাহসুদ। এ দুটি জলযান ১৯২৯ সালে তৈরি হয়। এর পরেই ছিল গত বুধবার রাতে পুড়ে যাওয়া মেরী এন্ডারসনের বয়স। আর বয়স বিবেচনায় পিএস লেপচার অবস্থান চতুর্থ, ১৯৩৮ সালে তৈরি। সমসাময়িক সময়ে তৈরি হয়েছে এমভি শেলা, পিএস টার্ন ও এমভি বাঙ্গালী। এগুলোও বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। এমভি আব্দুল মতিন ও মনিরুল হকের বয়স তুলনামূলক কম, ১৯৫০ সালে তৈরি। দুটি জলযানের বয়স ৬৪ পেরিয়ে গেছে। একই সময়ে তৈরি এমভি বড় আউলিয়া ও এমভি আলাউদ্দিন বছরের বেশির ভাগ সময় ডকইয়ার্ডে পড়ে থাকে। যাত্রীসেবা দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সেবা দিতে গিয়েই বিআইডাব্লিউটিসির ফতুর হওয়ার দশা। বরিশালের বর্ষীয়ান আবুল কাসেম হাওলাদার একসময় এসব জলযানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে তৈরি জলযানগুলো এখন পা ভাঙা ঘোড়ার মতো। নদীতে ভাসাতে গেলে প্রায়ই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। জোড়াতালির পর জোড়াতালি আর রঙের প্রলেপ এসবের খানদানি ভাবটুকুও ম্লান করে দিয়েছে।’ বিআইডাব্লিউটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুরনো জলযানগুলো আর যাত্রী কিংবা মালামাল টানার কাজে ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ এসব রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ব্যাপক। জলযানের সিংহভাগ ইঞ্জিন ভলভো কম্পানির হওয়ায় সেসব দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। তা কেনার জন্য সরাসরি সুইডেনে যেতে হয়। তা ছাড়া পুরনো হয়ে যাওয়ায় জলযানগুলো ধীরগতিতে চলাচল করে। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা জলযানগুলোয় যেতে সময় লাগে ২৪ ঘণ্টা। ফলে দিনের পর দিন যাত্রী সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জলযানগুলো প্রমোদতরী কিংবা ভাসমান রেস্তোরাঁ হিসেবে ঢাকা-চাঁদপুর কিংবা এর আশপাশে চলাচল করলে বরং ভালো আয় হবে। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণে নজরদারি থাকলে ধ্বংসের হাত থেকেও রক্ষা পাবে শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী জলযানগুলো।
No comments:
Post a Comment