বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছায় অভিবাসী হয়ে অর্থপাচার করার সন্দেহে ৭৮ বাংলাদেশিকে নজরদারিতে রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্ব আইন অনুসারে এসব সম্পদশালী ব্যক্তির আয়-ব্যয়সংক্রান্ত হিসাব, ব্যাংকিং লেনদেন, সম্পদের পরিমাণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে ৫৯টি বড় মাপের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও আইনের ফাঁক গলে অর্থপাচার করছে বলে রাজস্ব বোর্ড থেকে তালিকা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এনবিআরের নজরদারিতে। এনবিআর
সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার ভয়াবহভাবে বেড়েছে বলে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআর কর্মকর্তাদের। সরকারের উচ্চপর্যায়ের এমন নির্দেশের পর অর্থপাচারে কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখতে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল বা সিআইসি) জোর তৎপরতা শুরু করে। এ বিষয়ে সিআইসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরপর আছেন সরকারি ও বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। নামকরা শিল্পী, খেলোয়াড়, চিকিৎসক এবং আইনজীবীও রয়েছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা কম। দেশের প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনীতিবিদও আছেন তালিকায়, তবে তাঁদের প্রত্যেকেই রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করেন। ৭৮ বাংলাদেশির ২৯ জনই দ্বৈত নাগরিক। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, স্বেচ্ছায় অভিবাসী হওয়া ৭৮ বাংলাদেশির তালিকা করে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের কাছে জমা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৫৯ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নামও এ তালিকায় উল্লেখ করা হয়। তালিকায় থাকা নাম নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান এরই মধ্যে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে। গোপনীয় এ বৈঠকের পর তালিকায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নজরদারি আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্র্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এনবিআর অর্থপাচারকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, স্বেচ্ছা অভিবাসন নেওয়া অর্থপাচারকারীদের প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা করেছে এনবিআর। তবে এ তালিকা থেকে অর্থপাচারকারীদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে সরকারি অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা নিতে চিঠি দেওয়া হবে। সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআরের তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় অভিবাসন নিয়েছেন মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশে। এসব দেশে অভিবাসী হয়ে তাঁরা দীর্ঘদিন থেকে অর্থপাচার করছেন। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ থেকে বেশি অর্থপাচার প্রতিবেশী দেশ ভারতে হলেও শুধু স্বেচ্ছা অভিবাসন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। তালিকায় থাকা ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছায় অভিবাসন নেওয়া দেশে ব্যবসা আছে। প্রত্যেকেই এলসি খুলে সে দেশ থেকে মালপত্র আনছেন। বিদেশে যে পরিমাণ ব্যবসা আছে তার তুলনায় ব্যাংকিং লেনদেন অনেক কম। সূত্র মতে, তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রাজস্বখেলাপি ও ঋণখেলাপি। প্রভাবশালী এসব ব্যক্তি আদালতের আশ্রয় নিয়ে বছরের পর বছর বিষয়গুলো ঝুলিয়ে রেখেছেন। এনবিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, তালিকাভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা চিকিৎসার নামে মূলত বিদেশে অর্থ পাঠান। তাঁদের সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করেন। অনেকের স্ত্রী ও সন্তানরা স্বেচ্ছায় অভিবাসী হওয়া দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ব্যাংকিং লেনদেনের বাইরে গিয়ে অর্থপাচার করতে এসব আমলা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনছেন বিদেশে। বেশির ভাগ ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় অভিবাসন নিয়েছেন। তবে আইনি সক্ষমতা না থাকায় বিদেশে এসব ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব বা সম্পদ জব্দ করা সম্ভব হচ্ছে না এনবিআরের পক্ষে। আইনি সক্ষমতা চেয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান এরই মধ্যে চিঠি পাঠিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কাছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তালিকাভুক্ত ৫৯ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা আছে। এসব প্রতিষ্ঠান আইনের ফাঁক গলে অর্থপাচার করছে বলে সিআইসির প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘন ঘন সেমিনার আয়োজনের নামে বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনতে বাজারমূল্যের চেয়ে অতি উচ্চ ফি দিচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠানের হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকলেও এ খাতে কম অর্থ পরিশোধ করে বাকি অর্থ পাচার করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নামে উচ্চ মূল্যে বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি, যন্ত্রপাতি আমদানিতে অর্থপাচার করা হচ্ছে। বিশেষভাবে সফটওয়্যার আমদানিতে একটি প্রতিষ্ঠান মাসে ১০-১৫ কোটি টাকার হিসাব দেখাচ্ছে। এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সফটওয়্যার সিডিতে আমদানি হয়। প্রকৃতপক্ষে একটি সিডিতে কত টাকার সফটওয়্যার আসছে বা আদৌ সিডিতে কোনো সফটওয়্যার আনা হচ্ছে কি না তা যাচাই করার মতো উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নেই কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে। তাই সিডিতে সফটওয়্যার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান যে হিসাব দিচ্ছে তাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এভাবে বড় অঙ্কের অর্থপাচার করছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।
No comments:
Post a Comment