যৌতুক অথবা মাদক সেবনের টাকা না পেয়ে স্বামী আগুন দিচ্ছে স্ত্রীর গায়ে, নৃশংস উপায়ে হত্যা করছে, চলছে ভয়াবহ নির্যাতন। দাম্পত্য বিরোধেও স্বামীর হাতে খুন হচ্ছে স্ত্রী আবার স্বামীকে হত্যা করছে স্ত্রী। সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তির বলি হচ্ছে নারী ও শিশুরা। পুড়িয়ে মারা হচ্ছে স্ত্রী-কন্যাদের। সম্পত্তি অথবা দাম্পত্য বিরোধের সূত্রে শিশু হত্যার মতো ঘটনায় জড়াচ্ছে মা-বাবা। কখনো কখনো রাজনৈতিক বিরোধও নৃশংসতা ঘটাচ্ছ
ে পরিবারে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে এ রকম বীভৎস সব ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক। নিষ্ঠুরতার মাত্রায় ছড়াচ্ছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। নারী ও শিশুরাই নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে বেশি। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের শিথিলতায় এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইনি প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, বিচারপ্রক্রিয়ার শিথিলতাসহ নানা দুর্বলতা সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে পারিবারিক অনুশাসন। সাম্প্রতিক নানা ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দাম্পত্য ও পারিবারিক কোন্দল দ্রুতই গড়াচ্ছে সহিংসতার দিকে। নির্যাতন চিত্রগুলোও আগের তুলনায় বীভৎসতায় ভরা। সামাজিক বিরোধেও নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনা ঘটছে। গত ৮ অক্টোবর সাতক্ষীরার কলারোয়ায় কলেজশিক্ষক খলিলুর রহমানের ঘরে আগুন দিয়ে পুরো পরিবারকে হত্যার চেষ্টা হয়। দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইতিমধ্যে মারা গেছেন খলিলুর রহমানের স্ত্রী ঝরনা বেগম। দুই শিশুপুত্রসহ খলিল এখনো চিকিৎসাধীন। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধের সূত্রে এ নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ ধারণা করছে। একই রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুরে চম্পা বেগম নামে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে হত্যার চেষ্টা হয়। গত বুধবার রাতে তিনি মারা যান। জমিসংক্রান্ত বিরোধে চাচাশ্বশুর এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ। নরসিংদীতে যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্বামী পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে সালেহা আক্তার (২২) নামের এক গৃহবধূকে। মারাত্মক দগ্ধ এ গৃহবধূ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সর্বশেষ রাজধানীর কল্যাণপুরে নিজ বাসায় স্বামীকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন দুই সন্তানের জননী লাবনী আক্তার। স্বামী সালাহ উদ্দিন দ্বিতীয় বিয়ে করায় ক্ষুব্ধ হয়ে লাবনী তাঁকে হত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। নৃশংস এ হত্যা ঘটনার পর লাবনী এক দিন ঘরের ওয়ার্ডরোবে লাশ রেখে দেন এবং বুধবার রাতে নিজেই পুলিশে সংবাদ দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এদিকে চট্টগ্রামের রাউজানে স্বামীকে হত্যার পর লাশ মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন স্ত্রী শাহনাজ বেগম (৩২)। গত ঈদের রাতে দাম্পত্য কলহের একপর্যায়ে স্বামী ট্যাক্সিচালক দুদু মিয়াকে (৩৮) হত্যা করে তিনি ঘরের পাশে লাশ পুঁতে সেখানে রান্নাবান্না করতে থাকেন। গত বুধবার রাতে পুলিশ সন্দেহবশত আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে শাহনাজ অবলীলায় এ হত্যা ঘটনার বর্ণনা দিলে মাটি খুঁড়ে লাশ তোলা হয়। চিকদাইর দক্ষিনসত্তা গ্রামের এ গৃহবধূর দাবি, তাঁদের দুই সন্তান রয়েছে। স্বামীর পরকীয়ার কারণেই স্বামীর সঙ্গে তর্ক এবং খুনের ঘটনা। পারিবারিক অপরাধমূলক এ রকম ঘটনায় ক্রমেই বাড়ছে উদ্বেগ। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক ও পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ মাদক ও পরকীয়া। যৌতুক, সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সমাজ পরিবর্তনের অসুস্থ ধারা, অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিবর্তন, সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্যসহ নানা কারণেও অসহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এরই প্রকাশ ঘটছে সহিংসরূপে। সর্বোপরি এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতাকেও দায়ী করেছে অনেকে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, “সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই মূলত এ রকম নানা ঘটনা ঘটছে। সমাজ পরিবর্তনের ধারা অস্বাভাবিক হওয়ায় পারিবারিক অনুশাসন ও মূল্যবোধ ক্ষয়ে গেছে। আর মাদকের প্রভাব ও আকাশ সংস্কৃতির কারণে ‘নিষ্ঠুরতা’, ‘নৃশংসতা’ অনেকের মাঝে প্রভাব ফেলছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং তা গড়াচ্ছে নির্যাতনের দিকে। সব মিলিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা বাড়ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশে অনেক পারিবারিক নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটেছে। তাতে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার দায় রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্রোধবশত অনেকে নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু আইনি প্রচেষ্টায় এ অবস্থার উন্নতি হবে না, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি মূল্যবোধ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান নৃশংস কর্মকাণ্ড অসুস্থ ও অস্থির সমাজের নির্দেশক। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গত ৬ অক্টোবর ঘটে এক পৈশাচিক ঘটনা। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সেখানে একই পরিবারের চারজনকে ঘরে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে বখাটেরা। গৃহবধূ হাসনা বেগম (৩৫), তাঁর তিন মেয়ে মনিরা আক্তার (১৪), মীম আক্তার (১১) ও মলি আক্তার (৭) ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় এ নিষ্ঠুরতার শিকার হয়। গত শুক্রবার ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সৎমায়ের হাতে মাইমুনা আক্তার নামে ছয় বছর বয়সী এক শিশুর প্রাণ গেছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা সৎমা সুমাইয়া ইসলাম শারমিন ইতিমধ্যে হত্যার বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মাইমুনাকে গলাটিপে শ্বাস রোধ করার পর বাথরুমের ড্রামে মাথা চুবিয়ে হত্যা নিশ্চিত করেন শারমিন। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনিসেফ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে শীর্ষে। ৪৭ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে এ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ হার ৩৪ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুসারে সারা বিশ্বের মধ্যে নারী নির্যাতনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ গিনি। সেখানে ৭৩ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামী দ্বারা নির্যাতিত। নৃশংসতা ও সামাজিক অপরাধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বলেন, সমাজ একটা পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সমাজ যত আধুনিক হবে, সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব ততই বাড়বে। সমাজ পরিবর্তনের এ ধারার সঙ্গে সবাই খাপ খাওয়াতে পারছে না। আধুনিকতার অনেক খারাপ উপাদান বিস্তৃত হচ্ছে, যার প্রভাবেই সামাজিক অপরাধ ও নৃশংসতা বাড়ছে। সামগ্রিক সমাজব্যবস্থায় এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা নিরসনে সমন্বিত অনেক উদ্যোগ প্রয়োজন। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, পারিবারিক সহিংসতার প্রধান শিকার নারী ও শিশু। অনেক সময় দীর্ঘ মেয়াদে নির্যাতিত হয়ে নারীও ক্রোধবশত সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে বসে। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কমানো গেলে সামাজিক অস্থিরতা ও সহিংসতা অনেক কমে আসবে বলেও অভিমত দেন অনেকে। পারিবারিক সহিংসতার আলাদা পরিসংখ্যান না থাকলেও মামলা বিশ্লেষণ করে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। এ বছর জানুয়ারি মাসে সারা দেশে এক হাজার ১২৭টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল। ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ২৫৬, মার্চে এক হাজার ৬৬৯, এপ্রিলে এক হাজার ৯৮৮, মে মাসে দুই হাজার ৬৯, জুনে এক হাজার ৯৮১, জুলাইয়ে এক হাজার ৮২৩ এবং আগস্টে দুই হাজার ২১৩ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জরিপ অনুসারে ২০১৩ সালে সারা দেশে চার হাজার ৭৭৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ছিল, যার মধ্যে ধর্ষণ ৬৯৬, গণধর্ষণ ১৮৫ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ছিল ৯৪টি। এ বছর প্রথম ছয় মাসে দুই হাজার ২০৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আর গত আগস্ট মাসে এ চিত্র ছিল যথেষ্ট ভীতিকর। গত আগস্ট মাসে সারা দেশে ৫০৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। চলতি মাসে ৯৯ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫২ জন নারী। তাদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে। এ সময়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১০৭টি, তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯ জনকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৭ জনকে, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে চারজন এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে দুজন। এসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে দুজন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে চারজন, তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের।
No comments:
Post a Comment