Monday, November 24, 2014

লতিফ সিদ্দিকী হঠাৎ ঢাকায়, নাটকীয়তা:কালের কন্ঠ

মন্ত্রিত্ব হারানো এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী প্রায় দুই মাস পর হঠাৎ দেশে ফিরেছেন। গতকাল রবি
বার রাতে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে করে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে নিয়ে হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। ইমিগ্রেশন পুলিশ ও গোয়েন্দারা স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে ঘিরে ধরেন। তিনি বিমাবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অবস্থান করছিলেন। পরে রাত ৯টা ২৬ মিনিটে তিনি পুলিশ পাহারায় বিশেষ গেট দিয়ে বাইরে চলে যান বলে জানা যায়। সেখান থেকে তিনি ধানমণ্ডিতে নিজের বাসায় গেছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। হজ ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করার জের ধরে ব্যাপক নিন্দা-সমালোচনার মুখে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ খোয়ানো ছাড়াও দেশের বিভিন্ন আদালতে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে তাঁর বিরুদ্ধে। পুলিশের একটি সূত্রে জানা যায়, স্পিকারের অনুমতি না থাকায় বিমানবন্দরে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। আজ সোমবার তাঁর সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনার কথাও গত রাতে আলোচনায় এসেছে। তবে এর আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করার অনুমতি মিলতে পারে বলে জানা গেছে। এদিকে গতকালই লতিফ সিদ্দিকীকে বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার করার দাবি জানায় হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনের আমির শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী এক বিবৃতিতে বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে কৌশলে বাঁচানোর চেষ্টা করা হলে শিগগিরই দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে হেফাজত। প্রয়োজনে ঢাকা ঘেরাও এবং লাগাতার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া আহলে সুন্নাত আল জামাত বলেছে, লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করা না হলে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও করবে। নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, রাত ৮টা ২১ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন লতিফ সিদ্দিকী। সোয়া ৯টা পর্যন্ত তিনি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের দোতলায় দোলনচাঁপায় অবস্থান করছিলেন। ওই সময় পুলিশের একটি বিশেষ টিম বিমানবন্দরে প্রবেশ করে। এর কিছুক্ষণ পরই তিনি ঢাকা মেট্রো-গ-৩৫-৭৭৮৫ নম্বর গাড়িতে করে বেরিয়ে যান বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ গেট দিয়ে। প্রথমে অবশ্য ভিআইপি গেট ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। জানা যায়, লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে করণীয় জানতে পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করেন। সরকারের পক্ষ থেকে ‘সিগন্যাল’ পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। বিমানবন্দরে পুলিশকে ধমকালেন : লতিফ সিদ্দিকীর আগমনের খবর আগেই পেয়েছিলেন তাঁর কয়েকজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তাঁরা ভিআইপি লাউঞ্জে আগে থেকে অপেক্ষা করছিলেন। বিমানবন্দরে নেমেই ভিআইপি লাউঞ্জে চলে যান লতিফ সিদ্দিকী। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে হঠাৎ বিমানবন্দরে লতিফ সিদ্দিকীকে দেখতে পেয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাসহ নিরপত্তাকর্মীরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। ওই সময় শতাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাঁকে ঘিরে রাখেন এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ প্রহরায় লতিফ সিদ্দিকীকে দোতলায় দোলনচাপা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সেখানেও অর্ধশত পুলিশ তাঁকে ঘিরে রাখায় উত্তেজিত হয়ে ওঠেন লতিফ সিদ্দিকী। পুলিশকে উদ্দেশ করে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার রূপ কি চেঞ্জ হয়ে গেছে, আমার রূপ কি তোমরা আগে দেখনি? আমার সামনে এত ভিড় করছ কেন? আমি বলছি, এখান থেকে তোমরা সরে যাও।’ ওই সময় তাঁর কথার কোনো কর্ণপাত না করে ওয়্যারলেসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করতে থাকেন ওই কর্মকর্তারা। বিমানবন্দর থানার ওসি শাহ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিমানবন্দরে তিনি (লতিফ সিদ্দিকী) এসেছেন শোনার পরপরই আমরা সেখানে যাই, তবে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কিংবা ওপরের নির্দেশনা না থাকায় উনাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।’ গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীকে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তিনি ধানমণ্ডির বাড়িতে অবস্থান করলেও পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন। সরকারের ওপর মহলের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ। নির্দেশনা পেলেই গ্রেপ্তার করা হবে। ১৮ জেলার ২২ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা : ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ ১৮টি জেলায় ২২টি মামলা হয়। নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় প্রতিটি মামলায় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এত দিন পাশের দেশ ভারতে ছিলেন বলে জানা গেছে। গতকাল ঢাকার একটি আদালতে পরোয়ানা জারি সংক্রান্তে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে কোনো প্রতিবেদন না আসায় ঢাকার মহানগর হাকিম ইউনুস আলী খান আগামী ৩০ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পরবর্র্তী দিন ধার্য করেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ও মানহানির অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের এই সাবেক নেতার বিরুদ্ধে গত ২ অক্টোবর মামলাটি করেন অ্যাডভোকেট শাহ আলম। ওই দিন বাদীর জবানবন্দি গ্রহণপূর্বক আসামির বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়ে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ইসলামাবাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার যদি তাঁকে প্রশয় দেয়, তাহলে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হবে। কবে এ কর্মসূচি দেওয়া হবে সে বিষয়ে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালীন গত ২৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল সমিতি আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তৃতার একপর্যায়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোর বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছে। এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রোডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন করছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা নিয়ে ওখানে দিয়ে আসছে। এভারেজ যদি বাংলাদেশ থেকে এক লাখ লোক হজে যায়, প্রত্যেকের পাঁচ লাখ টাকা করে ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়।’ তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কেও বিতর্কিত ও অবমাননাকর মন্তব্য করেন। এ ছাড়া ওই অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন। জয় ভাই কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নন। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ারও কেউ নন।’ এ ঘটনায় লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়াসহ দলীয়ভাবেও ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ইঙ্গিত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানিকতা সারতে কিছু সময় লাগে। গত ১২ অক্টোবর লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ধর্মকর্ম পালন করে, নামাজ পড়ে, হজ পালন করে। অথচ তিনি (লতিফ সিদ্দিকী) কেন বা কিসের জন্য কটূক্তি করলেন, এটা বলতে পারব না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা একটা গর্হিত কাজ।’ ওই সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে লতিফ সিদ্দিকীকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদের পাশাপাশি দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

No comments:

Post a Comment