বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে মূল গডফাদাররা। তাদের ধারেকাছে ভিড়
তে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া চোরাকারবারিরা জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। বিশেষ করে বিমানের প্রভাবশালী ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে হতভম্ব তদন্ত কর্মকর্তারা। এসব চোরাকারবারি ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারের আগে থেকেই সব বিমানবন্দরে কঠোর নজরদারি চলছে। পলাশ জানান, এ পরিস্থিতিতে সমুদ্রপথ বেছে নিয়েছে চোরাকারবারিরা। গত এক বছরে সমুদ্রপথে ১২টি সোনার চালান পাচার করা হয়েছে। সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরাতের একাধিক জাহাজ দিয়ে সোনা পাচার করেছেন সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া পলাশ। সূত্র জানায়, পলাশের স্ত্রী ও বিমানের ক্রু নুরহাজান বেগম তাঁকে সহযোগিতা করেছেন বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন আহমেদের নাম ভাঙিয়ে পলাশ ও তাঁর গ্রুপের সদস্যরা চোরাকারবারসহ নানা অপকর্ম করেছে। ঠিকাদারের পাশাপাশি তিনি নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। ধৃত চোরাকারবারিদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে এবার পুলিশের চোখ পড়েছে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দিকে। ইতিমধ্যে দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে ফেলেছে ডিবি পুলিশসহ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও সন্দেহের চোখে রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোনা পাচারে জিরো টলারেন্স আনা হবে। রাঘব বোয়ালরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের ধরা হবেই। বিমানের আরো কর্মকর্তা সোনা পাচারে জড়িত বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী বুঝি না। যারা এসব অপকর্ম করে আসছে তাদের ক্ষমা নেই।’ এ ব্যাপারে বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশ-র্যাব, শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমসকে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, সমুদ্র এলাকায়ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তারকৃত বিমানের প্ল্যানিং অ্যান্ড শিডিউলিং প্রধান ক্যাপ্টেন আবু মোহাম্মদ আসলাম ওরফে শহীদ, ডিজিএম এমদাদুল হক এমদাদ, শিডিউল ম্যানেজার তোজাম্মেল হোসেন, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ ও উত্তরার ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক হারুন অর রশীদকে তিন দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রথমে তাঁদের আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পাঁচজনই অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন। ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, কয়েক মাস ধরে সবকটি বিমানবন্দরে কড়াকড়ি থাকায় জাহাজে করে অন্তত ১২টি সোনার চালান আনা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সোনার চালানগুলো খালাস করা হয়। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরাত থেকে যেসব জাহাজ আসে ওই সব জাহাজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি থাকে। ফলে অন্য কেউ চালানের বিষয়টি টের পায় না। পলাশ জানিয়েছেন, জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর পর স্পিড বোটে করে সোনার চালানগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়। সূত্র জানায়, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি কাস্টমস কর্মকর্তাদের ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শতাধিক কর্মকর্তার নাম যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। পাশাপাশি শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তাদের নজরদারিতে আনা হয়েছে। পলাশের স্ত্রী ও বিমান ক্রু নুরজাহানের আমলনামাও তৈরি করা হয়েছে। গত এক বছরে পলাশ চোরাচালানের পাশাপাশি নিয়োগ বাণিজ্যও করেছেন। এ পর্যন্ত পলাশ ১০ জন বিমান ক্রু নিয়োগ দিয়ে ফেলেছেন। নিয়োগের ব্যাপারে বিমানের চেয়ারম্যান তাঁকে সহযোগিতা করেছেন বলে পলাশ দাবি করেছেন। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হযরত শাহজালালসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১২ জন দুর্ধর্ষ সোনা পাচারকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে আটজনের পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। ওই আটজন একাধিকবার দুবাই, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, ভারত ও পাকিস্তানে যাতায়াত করেছে। শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এই আটজন ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখত। আট কারবারি হলো গাজীপুরের টঙ্গীর সানাউল্লার ছেলে মো. রফিকুল ইসলাম, সিলেটের কানাইঘাটের বশির আলীর ছেলে আবদুল জলিল, শরীয়তপুর ভজেশরের ইসমাইল খানের ছেলে ইলিয়াস খান, ফেনীর রামপুরের নুরুল আমীনের ছেলে হাবিব পাটওয়ারি, মাদারীপুরের মোস্তফাপুরের সোলায়মান আলীর ছেলে মনিরুজ্জামান, সিলেটের কানাইঘাটের ইউসুফ আলীর ছেলে মো. আফতাব উদ্দিন, কানাইঘাটের মাহবুবুর উদ্দিন ও আহিবুর জামান। তাদের ধরার চেষ্টা চলছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। ডিবির সহকারী কমিশনার মিনহাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোনা চোরাকারবারিরা এবার সমুদ্রপথও ব্যবহার করছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। কিছু কাস্টমস কর্মকর্তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ধৃত পাঁচজনের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। রিমান্ড শেষ হলে তাঁদের আবার রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হবে। ডিবির আরেক কর্মকর্তা বলেন, সমুদ্রপথে নিরাপত্তা বাড়াতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে রাঘব বোয়ালরা তাঁদের জালে আটকা পড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
No comments:
Post a Comment