Sunday, November 23, 2014

সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যেতে হারিয়ে যাচ্ছেন শত যুবক:প্রথম অালো

সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় কাজের সন্ধানে যেতে গিয়ে বাংলাদেশের অনেক যুবক থাইল্যান্ডে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়ার সময়ই মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন।  অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর (রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট) সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য উপস্থাপন করা হয়। গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কেবল বাংলাদেশের দালালেরাই নয়,
আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রও এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে একটি মামলাও করা হয়নি। সরকারকে দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জের ১০ জন ভুক্তভোগী। তাঁদের কারও সন্তান, কারও বাবা, আবার কারও বা স্বামী নিখোঁজ। সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে তাঁরা নিখোঁজ আছেন। পরিবারের সদস্যরা জানেন না, আদৌ তাঁরা বেঁচে আছেন কি না। কথা বলতে গিয়ে তাঁরা বারবার কাঁদছিলেন। তাঁদের সেই কান্না ছুঁয়ে যাচ্ছিল উপস্থিত সবাইকে। রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা সিরাজগঞ্জে প্রাথমিক অনুসন্ধান চালিয়েছি। সিরাজগঞ্জের সাতটি উপজেলা থেকে চার হাজারের বেশি তরুণ অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গেছেন। এর মধ্যে চার শতাধিক মানুষ নিখোঁজ। এই যদি হয় একটি জেলার চিত্র, তবে পুরো দেশের চিত্র কতটা ভয়াবহ আমরা সহেজই অনুমান করতে পারি।’ সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থেকে আসা মোসাম্মৎ রহিমা বলেন, ‘আমার স্বামী শফিকুর ট্রলারে করে মালয়েশিয়া গেছে। কীভাবে গেল, কার মাধ্যমে গেল, আমরা কিছুই জানি না। হঠাৎ করে একদিন ফোন করে কান্নাকাটি করল। বলল, তারা অত্যাচার করছে। দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। দালালেরা একটা বিকাশ নম্বর পাঠাল। সেখানে টাকা দিলাম। কিন্তু তিন মাস ধরে স্বামীর খোঁজ নেই। বেঁচে আছে কি মরে গেছে, তাও জানি না।’ বৃদ্ধ আবদুল আজিজ, মুসলিম প্রামাণিক, সানোয়ার হোসেন, আবুল হাশেম, আমিনুল ইসলাম, কোহিনূর বেগম ও গনি মিয়ার গল্পও প্রায় একই রকম। তাঁদের স্বজনদেরও কোনো খোঁজ নেই। প্রত্যেকেই জানালেন, হঠাৎ একদিন জানতে পারেন, তাঁদের স্বজনেরা ট্রলারে করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। কিন্তু পথে টাকার জন্য তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু টাকা দেওয়ার পর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘সুমদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়া নিয়ে ২০১২ সালেই আমরা নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থার (ইউএনএইচসিআরের) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮৭ হাজার লোক সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ার পথে পাড়ি দিয়েছে।’ তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘সমুদ্র শান্ত থাকার কারণে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি সময়টাকে অবৈধ অভিবাসনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এখন যাঁরা অবৈধভাবে যাচ্ছেন তাঁরা যশোর, খুলনা, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নাটোর থেকে যাচ্ছেন। কেবল এই এলাকা কিংবা কক্সবাজার-চট্টগ্রামের দালালেরাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন চক্র।’ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালক শিপা হাফিজ বলেন, যা হচ্ছে তা সরাসরি পাচার। আর কত মানুষ হারিয়ে গেলে সবার হুঁশ হবে? সিরাজগঞ্জের দালালদের বিরুদ্ধে কেন সেখানকার প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? আর আইন যতই থাকুক, সাধারণ মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান বলেন, আজকে এখানে নয়-দশজন লোক তাঁদের দুর্দশরা কথা জানালেন। সারা দেশে এমন হাজারো ভুক্তভোগী আছেন। দ্রুত এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। রামরুর সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘আজ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের অভিবাসনব্যবস্থা কতটা অনিরাপদ। দ্রুত এ ব্যাপারে একটি টাস্কফোর্স করা হোক। আর মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে লোক পাঠানো নিয়ে আমাদের কোনো ভুল নীতি থাকলে সেখান থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।’ অভিবাসনবিষযক বেসরকারি সংস্থা ওয়্যারবির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, ‘আজকে আমরা সত্যের মুখোমুখি। বাস্তবতা হলো, বৈধভাবে লোকজন সেভাবে মালয়েশিয়ায় যেতে পারছে না। অথচ সেখানে লোক লাগবে। কাজেই মরিয়া হয়েই লোকজন যাচ্ছে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রও জড়িত। ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসের আগেই আমরা সরকার থেকে এ ব্যাপারে প্রতিকার চাই।’ বেসরকারি আরেকটি সংস্থা অকুপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘যাওয়ার আগে কোনো টাকা দিতে হয় না বলে সাধারণ মানুষ বিদেশে যাওয়ার লোভে এই পথে পা বাড়ায়। আমরা বারবার শুনি টেকনাফে ট্রলার আটক হচ্ছে। সেখানে কি এখনো কোন পাচারকারী ধরা পড়েনি? আর ধরা পড়লে কী ব্যবস্থা নিল সেখানকার প্রশাসন?’ নারী অভিবাসীবিষয়ক সংস্থা বমসার নির্বাহী পরিচালক শেখ রোমানা বলেন, সারা দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা উচিত। সংবাদ সম্মেলন থেকে দ্রুত সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া পুনর্মূল্যায়ন, ২০১৩ সালের অভিবাসন আইনের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। বায়রার মাসিক ফোরামের সভা: এর আগে সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মাসিক ফোরামের দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জনশক্তি রপ্তানি খাতের নানা সমস্যা নিয়ে অলোচনা হয়। সভায় ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার ঢাকার মিশন-প্রধান শরত দাস, বায়রার সভাপতি আবুল বাসার, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী, মহাসচিব মনসুর আহমেদ, হাসান আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।

No comments:

Post a Comment