তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রশ্নে চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে এই ধারাটি সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী, অন্যদিকে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এই আইনের কৌশলগত কিছু ‘শব্দ’ প্রয়োগের ফলে সমাজের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিবাজদের অসীম ক্ষমতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে, অনেক ক্
ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকরা সাধ্যমতো তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করলেও এই ধারার কারণে পদে পদে হয়রানি ও নাজেহাল হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এতে করে মূলত দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পাবে এবং পাচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শুধু নামেমাত্র ঠিক থাকবে। কিন্তু বাস্তবে গণমাধ্যমে কারও অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে কিছুই লেখা যাবে না। সরকার চাইলে যে কাউকে এ আইনে আটকে ফেলে জেলে পাঠিয়ে দিতে পারবে। আইনটির ৫৭ ধারা প্রসঙ্গে অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে এমন সব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ। তারা যুগান্তরকে বলেন, মূলত সাইবার ক্রাইম, জঙ্গি সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি গত বছর সংশোধন করা হলেও প্রকারান্তরে তা গণমাধ্যম দমনের হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এদিকে এ প্রসঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মেদ পলক শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনটির বিষয়ে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব সমালোচনা পাচ্ছি সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে দেখা হবে। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে আইনের এই ধারাটি সংশোধনে বিবেচনা করা হবে।’ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘৫৭ ধারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষুণ্ন করছে। সরকারের দুর্নীতি, অদক্ষতা যাতে সাংবাদিকরা প্রকাশ না করতে পারেন সেজন্য আইনটিতে এ ধরনের সংশোধনী আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার এ ধারার ব্যবহারও শুরু করছে। এর ফলে সাংবাদিকরা আতংকিত হয়ে পড়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘এ ধারাটি সংবিধান পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। তাই অবিলম্বে এ ধারাটি বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘মুদ্রণ মাধ্যমে প্রকাশের এক শাস্তি আর অনলাইনে প্রকাশের অন্যরকম শাস্তি। এটা অযৌক্তিক। এ ধরনের আইনের সংশোধনী আনা দরকার।’ ৫৭ ধারায় যা আছে : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃংখলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক শনিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা না পড়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’ বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা : সূত্র জানায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণা করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়–য়াসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী। আইনজীবীদের পর্যালোচনা ও গবেষণায় ধারাটিতে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতি বেরিয়ে আসে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধারাটি সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে প্রথমে যুগান্তরের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মূলত ধারাটিতে ৭টি বড় ধরনের অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে। এগুলো হল, মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইনশৃংখলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি। তার মতে, ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচারের কথা বলা হচ্ছে যা হবে মিথ্যা বা অশ্লীল। কিন্তু সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নীতি বা নৈতিকতার কথা বলা থাকলেও কোন কোন বিষয়বস্তুকে অশ্লীল বা মিথ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে তা এই ধারায় সুস্পষ্ট করা হয়নি। এক্ষেত্রে এ আইনটি সুনির্দিষ্টতার অভাবের কারণে দুষ্ট। নীতিভ্রষ্টতা বিষয়ে এই ধারায় বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন, নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হওয়া বলতে কী বোঝাবে- তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আইনটিতে নেই। মানহানির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘যা দ্বারা মানহানি ঘটে’। কিন্তু তার মতে, এটিও আইনের মূল ধারার সঙ্গে সংগতিবিহীন। কারণ ইন্টারনেটে প্রকাশ করলে ১৪ বছর জেল ও যা অজামিনযোগ্য। অথচ একই বিষয় মুদ্রণ সংস্করণে প্রকাশ করলে ২ বছর জেল এবং জামিনযোগ্য। একই অপরাধে এ ধরনের বড় অসঙ্গতি নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এটাই স্বাভাবিক এবং কোনোভাবে ন্যায়বিচার হিসেবে বিবেচিত হবে না। এছাড়া নতুন আইনে কেন সাজার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে তা আইনের কোথাও উল্লেখ নেই। আইনের এই অসমতা বিচারিক মানদণ্ডকেই প্রশ্ববিদ্ধ করে। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে’ আইনের এ বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত অস্পষ্ট ও অনির্ধারিত একটা অপরাধ। ‘আঘাত করতে পারে’ এমন অপরাধের বিষয় তখনই অনির্দিষ্ট হিসেবে গণ্য হবে। আর অনির্দিষ্ট কোনো অপরাধের কারণে আইন কোনো ব্যক্তিকে সাজা দিতে পারে না। একইভাবে আইনশৃংখলার অবনতি ঘটে বা ঘটনার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় ও তথ্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করার বিষয়টিও আইনে সুনির্দিষ্ট করা নেই। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া যুগান্তরকে আরও জানান, ‘৫৭ ধারাটি আইনটিতে এক প্রকার গোঁজামিলের ধারা। মূলত এ ধারাটি সংবাদপত্র ও নাগরিকের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে, যা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এই অনুচ্ছেদে, দেশের সব নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৫৭ ধারা যদি প্রচলিত থাকে তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহার করে অপছন্দের যে কাউকে দমন-পীড়ন চালানো যাবে। এমনিতেই মানুষ আতংকে রয়েছে। আর এই আতংকে থাকলে আর যাই হোক চিন্তার স্বাধীনতা থাকে না।’ এ ধারাটির অপব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন আরও কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞের মতে, ‘বিএনপি সরকারের আমলে তৈরি করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মানহানি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করাবিষয়ক ৫৭ ধারার আওতায় সারা দেশে মামলার সংখ্যা সংক্রামক ব্যাধির মতো দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে। আইনের অস্পষ্টতার কারণে এর অপব্যবহারের আশংকা অত্যন্ত বেশি। তারা মনে করেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য চরম হুমকি এ আইন। এ ছাড়া এ আইনের কারণে সাংবাদিক সমাজ আতংকিত। এদিকে আইনটির এ ধারার ত্রুটি ও অপব্যবহার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল যুগান্তরকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অগ্রহণযোগ্য। এর অপপ্রয়োগের শিকার হচ্ছেন অনেকে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও খর্ব করছে। সাংবাদিকদের মধ্যেও রয়েছে আতংক। তাই এ ধারাটি অবিলম্বে বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি। সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম শামীম। তার কাছে এ ধারার অপ্রয়োগের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আইনের অপব্যবহার যাতে না হয় এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক।’ প্রসঙ্গত, মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, মানহানিকর সংবাদ প্রকাশের অপরাধে এ আইনের ৫৭ ধারায় কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশ ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ কয়েকজন সাধারণ নাগরিকও দণ্ডিত হয়েছেন। বর্তমানে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ২৮টি মামলা বিচারাধীন। আর গত এক বছরে পাঁচটি মামলায় চারজনকে সাজা দিয়েছেন এ আদালত।
No comments:
Post a Comment