বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিমায়িত চিংড়ি রফতানি শিল্প বর্তমানে নানামুখী সংকটে। চাহিদার তুলনায় দেশে চিংড়ি উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশে বর্তমানে যে ক’টি হিমায়িত চিংড়ি রফতানিকারক কোম্পানি চালু আছে, তাদের বছরে চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টন। এর বিপরীতে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন। চিংড়িসহ বিভিন্ন সংকটে ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধেক হিমায়িত প্রক্রিয়াজাতকরণ ক
ারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলোকে নানামুখী সংকট মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে। অপরদিকে চিংড়িতে নাইট্রোফোরান (অ্যান্টিবায়োটিক) ইস্যু ও মান নিয়ন্ত্রণের (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) দেয়া সার্টিফিকেট টেম্পারিং ও চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের অভিযোগে অভিযুক্ত রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে বর্তমানে জরিমানা ও লাইসেন্স স্থগিত করা হচ্ছে। চিংড়িতে অপদ্রব্য (সাগু, আগর পাউডার ও জেলিজাতীয় জিনিস) পুশ করার ফলে বিশ্ববাজারে দেশের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে চিংড়ি রফতানি শিল্পে। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এস হুমায়ুন কবীর যুগান্তরকে জানান, সারা দেশে লাইসেন্সকৃত হিমায়িত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে ৯০টি। এর মধ্যে চালু আছে ৪০টির মতো। খুলনায় ৫০টির মধ্যে চালু আছে ৩৫টি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৫টি চালু আছে। বাকি কারখানাগুলো চিংড়ির অভাব, ব্যবস্থাপনার সংকট ও অর্থনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি কারখানা ছিল। দিনে দিনে চিংড়ি চাষ কমে যাওয়া এবং চাষে আধুনিকতার ছোঁয়া না লাগায় উৎপাদনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাড়ছে না। অতীতে যে কোনো বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে চিংড়ি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ফলে সম্ভাবনাময় এই শিল্প সংকটে পড়েছে। তিনি জানান, প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি হেক্টরে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে ৭০০ থেকে ১০০০ কেজি। থাইল্যান্ডে ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি এবং ভিয়েতনামে ২৫০০ থেকে ৩০০০ কেজি। সেখানে আমাদের দেশে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি। বাংলাদেশে চিংড়ি উৎপাদন এত কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, এখনও আমাদের দেশের অনেক চাষি সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করছে। ব্যাংক ঋণ না পাওয়া এবং ঋণ পেলেও সময়মতো না পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিংড়ি চাষ হচ্ছে না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও এলাকাভিত্তিক অপপ্রচারেও চিংড়ি চাষ হ্রাস পাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে এই শিল্পে। হুমায়ুন কবীর আরও বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ যে পরিমাণ চিংড়ি রফতানি করে তা ৩ শতাংশের কম। যার কারণে ক্রেতা ও ভোক্তাদের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ফলে চিংড়ির মূল্য নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অথচ ভিয়েতনাম বিশ্ববাজারে চাহিদার ১৭ শতাংশ চিংড়ি রফতানি করে ভোক্তাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারছে। খুলনা মৎস্য অধিদফতরের (মান নিয়ন্ত্রণ) উপপরিচালক মো. আবদুর রাশেদ বলেন, উৎপাদন আগের তুলনায় কম, কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় রফতানি আয় বেশি হচ্ছে। দেশে এখনও চিংড়ি চাষ সনাতন পদ্ধতিতে হওয়াই এর কারণ। তবে ইদানীং উন্নত পদ্ধতিতেও চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে ২ টনের মতো। এর মধ্যেও দেশে লাইসেন্সকৃত হিমায়িত রফতানিকারক কোম্পানি চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ পাচ্ছে। ল্যাব ফ্যাসিলিটির বিষয়ে মৎস্য উপপরিচালক মো. আবদুর রাশেদ বলেন, বর্তমানে খুলনাসহ দেশে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব ফ্যাসিলিটি চালু আছে। জুলাই মাস থেকে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে রফতানিকারকদের মান নিয়ন্ত্রণ সনদ দেয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া যে অধ্যাদেশের কারণে রফতানিকারকদের কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে, সেটি সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, সম্ভাবনাময় এ শিল্পের সংকট ও ভাবমূর্তির জন্য কিছু অসৎ লোভী কারখানা মালিক, ডিপো মালিক ও মাছ সরবরাহকারী দায়ী। তারা চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে বিশ্ববাজারে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। ফলে এর প্রভাব রফতানি বাণিজ্যে পড়ছে। গত বছর পুশের কারণে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও ৭ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া গত বছর বেশ কটি হিমায়িত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানাকে ২২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ৪টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করা হয়। এছাড়া এ বছর অপদ্রব্য পুশ করায় সাড়ে চার হাজার কেজি চিংড়ি ধ্বংস করা হয়েছে এবং তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং এক ডিপো মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। উপপরিচালক বলেন, গত দুই বছর চিংড়িতে নাইট্রোফোরানের (অ্যান্টিবায়োটিক) অভিযোগ নেই বললে চলে। চিংড়িতে অপদ্রব্য : খুলনা অঞ্চলে রফতানিযোগ্য হিমায়িত চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে ওজন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বুধবার রাতে খুলনার রূপসা এলাকায় একটি চিংড়ি ডিপো থেকে অপদ্রব্য (সাগু ও জেলিজাতীয় জিনিস) মেশানো প্রায় এক মেট্রিক টন চিংড়ি জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। কোম্পানিতে আসার পর কমে যাওয়া ওজন ঠিক রাখতেই খুলনা অঞ্চলে মধ্যস্বত্বভোগীরা রফতানিযোগ্য চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করছে। একাধিক সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, খুলনা জেলায় প্রতিদিন কোটি টাকার চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা হচ্ছে যা কোম্পানির গ্রেটারদের যোগসাজশে প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করা হচ্ছে বিশ্বের প্রায় ২৭টি দেশে। পুশ করা চিংড়ি রফতানির কারণে এ শিল্পের সুনামও ক্ষুণœ হচ্ছে। সাধারণ চিংড়ি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, এই শিল্প থেকে সরকার বছরে ৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও পুশের ব্যাপারে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। সূত্র জানায়, ঘেরগুলো থেকে গলদা অথবা বাগদা চিংড়ি কোম্পানিতে আসার পর প্রতি মণে ওয়াটার লেস (পানির ওজন কম) ৫০০ গ্রাম কম, পালায় ফের ২০০ গ্রাম এবং বাস্কেটে (ঝুড়িতে) ওজন কম ২০০ গ্রামসহ মোট এক কেজি কম ধরা হয়। ফলে বিক্রেতাকে এক মণ চিংড়িতে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা লোকসান দিতে হয়। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীরা ঘের থেকে যখন চিংড়ি কেনেন তখন তাকে এক মণের দামই দিতে হয়। এজন্য তারা মাছে অপদ্রব্য পুশ করে। রূপসা চিংড়ি বণিক সমিতির সভাপতি আমিন মোল্লা বলেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক কোম্পানি অপদ্রব্য পুশের ভয়ে চিংড়ি কিনতে সাহস পাচ্ছে না। তারা খুব সতর্কতার সঙ্গেই এখন চিংড়ি কিনছেন।
No comments:
Post a Comment