Wednesday, April 22, 2015

সীমিত ক্ষমতাও কাজে লাগান না মেয়ররা:কালের কন্ঠ

ঢাকা ও চট্টগ্রামে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হতে মেয়র পদপ্রার্থীরা ভোটারদের কাছে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করছেন। এসব ইশতেহারে তাঁরা নগরবাসীকে অনেক সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী নির্বাচিত মেয়রদের সরকারি অনুমোদন বা করপোরেশনের অন্য নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সমর্থন ছাড়া এককভাবে কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তার পরও আইনে ম
েয়রদের যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ইচ্ছে করলে সেটুকু দিয়েই সমন্বয়ের মাধ্যমে তাঁরা নগরবাসীর জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে সে ক্ষমতাও কাজে লাগান না মেয়ররা। এ অভিমত নগরবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের। ২০০৯ সালের অক্টোবরে এ আইন প্রণীত হওয়ার পর এই প্রথম ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি সিটি করপোরেশন ভেঙে দুটি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসক দিয়ে চলছে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশেন। ফলে প্রশাসনিক ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর পর দুজন নির্বাচিত মেয়র পেতে যাচ্ছে রাজধানীবাসী। তাই নতুন মেয়রদের প্রতি নগরবাসীর প্রত্যাশার শেষ নেই। কিন্তু সিটি করপোরেশন আইন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুরনো মিউনিসিপ্যালিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে যে নতুন আইন করা হয়েছে, তাতে একজন মেয়র সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে মাত্র এক লাখ টাকাও যদি কাউকে প্রদান করতে চান, তাতেও অনুমোদন লাগবে। দেড় কোটির অধিক জনগোষ্ঠীর জন্য ঢাকা শহরে যেসব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে এবং নির্বাচিত মেয়রদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০০৯ সালে সরকার যে আইন করেছে, তা মেয়রদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। আইনে সিটি মেয়রদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, একজন সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও সরকার আইনের আওতায় এনে তাঁকে অপসারণ করতে পারবে। নির্বাচিত হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে শপথ নিতে ব্যর্থ হলেও তিনি পদ হারাবেন। কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলায় চার্জশিট বিচারিক আদালতে গ্রহণযোগ্য হলে তাঁকেও সরকার অপসারণ করতে পারবে। আইনের ধারা ১৩-এর ঙ অনুচ্ছেদে বলা আছে, যদি একজন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও প্রমাণিত হন তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ছিলেন তবে তাঁকেও অপসারণ করতে পারবে সরকার। এ ছাড়া কোনো ফৌজদারি মামলায় কারো দুই বছরের সাজা হলে তাঁকেও অপসারণ করার বিধান রয়েছে। পর পর তিন মাস একটানা করপোরেশনের সভায় অনুপস্থিত থাকলেও মেয়রকে সরকার অপসারণ করতে পারবে। তবে সিটি করপোরেশন আইনে মেয়রের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের এমন অভিযোগ নিরসনের ব্যবস্থা আইনেই রাখা আছে। ‘অসুবিধা দূরীকরণ’ শিরোনামে ১২৪ ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর করিবার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে সরকার উক্ত অসুবিধা দূরীকরণার্থ, আদেশ দ্বারা, প্রয়োজনীয় যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’ আবার মেয়র, কাউন্সিলর ও করপোরেশনের কর্মকর্তাদের জনসেবক আখ্যায়িত করে নিঃসংকোচে দায়িত্ব পালনের জন্য আইনি সুরক্ষাও দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে প্রণীত নতুন আইনের ১২৩ ধারায় উল্লেখ আছে- ‘এই আইন, বিধি বা প্রবিধানের অধীন সরল বিশ্বাসে কৃত কোন কার্যের ফলে কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে তজ্জন্য সরকার, কর্পোরেশন বা উহাদের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোন আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।’ বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্থপতি আবু সাইদ এম আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন কখনো একটি সিটির সব সেবা নিশ্চিত করতে পারে না। তার পরও একজন নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলর যদি ইচ্ছে করেন তবে তাঁরা নগরীর উন্নয়নে অনেক অবদান রাখতে পারেন। এ জন্য তাদের শুধু ইশতেহার ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। নির্বাচিত হলে সেই ওয়াদা পূরণের লক্ষ্যে চেষ্টা করতে হবে।’ নগর বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আসলে সিটি করপোরেশনগুলো হলো মেয়রসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। এখানে কাউন্সিলরদের কোনো ক্ষমতা নেই। মেয়র যদি কাউন্সিলরদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিছু করতে চান তবে নগরবাসী অনেকভাবে উপকৃত হতে পারে। যেমন মশক নিধন, মাদক প্রতিরোধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি।   বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ মোবাশ্বের হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, মেয়রদের ক্ষমতা অনেক সীমিত কিন্তু তাঁরা তার পরেও ইচ্ছে করলে নগরবাসীর জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। তিনি বলেন, ১৫ জন এমপির এলাকার ভোটে দুইজন মেয়র নির্বাচিত হবেন। তাই তাঁদের ক্ষমতা এমপিদের চেয়েও বেশি হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, কাউন্সিলররা মেয়রের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু নির্বাচিত মেয়ররা কাউন্সিলরদের ওপর নির্ভরশীল না, যদিও মেয়রকে কাউন্সিলরদের নিয়েই কাজ করতে হবে। তবে যদি মেয়র ইচ্ছে করেন তবে সিটি করপোরেশনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেন। পথচারীদের জন্য ফুটপাথ তৈরি এবং দুই সিটিতে কমপক্ষে ৫০০ করে এক হাজার টয়লেট ব্যবস্থা করতে পারে। কারণ এখন ঢাকা শহরে রাস্তার পাশে নাগরিকদের বিশেষ করে মহিলাদের জন্য কোনো টয়লেট নেই।  মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেয়রদের সিটি করপোরেশন এলাকায় নগরবাসীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, রাস্তাঘাট তৈরি ও মেরামত, রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট বসানোসহ নানামুখী উন্নয়নের আওতা দেওয়া আছে। কিন্তু তার বেশির ভাগই করতে হবে নিজস্ব আয় তথা ট্যাক্স কালেকশন থেকে। কিন্তু গত ৩০ বছরেও নগরবাসীর ওপর তেমন কোনো বর্ধিত করারোপ করা হয়নি। কারণ বিগত সব সরকারেরই ভোটের স্বার্থে নগরবাসীর ট্যাক্স বাড়াতে অনীহা ছিল। আর এ জন্যই নগরীর উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে সরকারের অর্থ বরাদ্দের ওপরই নির্ভর করতে হবে নবনির্বাচিত মেয়রদের। অথচ নিজের আয় বাড়ানোর জন্য করারোপের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে করপোরেশনকে। আইনের ৮২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্পোরেশন সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে প্রবিধান দ্বারা চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত সকল অথবা যে কোন কর, উপ-কর, রেইট, টোল ও ফিস ইত্যাদি আরোপ করিতে পারিবে। কর আদায়ের জন্য কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা যে কোন ইমারত বা স্থানে প্রবেশ করিতে এবং যে কোন জিনিসপত্র পরিদর্শন করিতে পারেন।’ এমনকি কোন ব্যক্তির বেতন-ভাতা থেকে প্রাপ্য কর কেটে নেওয়ার ক্ষমতাও করপোরেশনকে আইনে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু ক্ষমতা সিটি করপোরেশেনের রয়েছে। সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এ বলা আছে, ‘কর্পোরেশনের নিজস্ব তহবিল থাকবে, যেখানে কর্পোরেশেনের নিজস্ব সম্পদ ও উৎস থেকে আয়ের পাশাপাশি সরকার, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অনুদান জমা থাকবে। ওই তহবিল থেকে নিয়মিত ব্যয় ছাড়াও দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের স্বাধীনতা কর্পোরেশনের রয়েছে। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে আলাদা তহবিলও গঠন করা যাবে। আইনের ৭৫ ধারায় বলা আছে, ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে সরকারের অর্থ বরাদ্দের প্রেক্ষিতে, মেয়র জনস্বার্থে যে কোন জরুরি কার্য সম্পাদন করিতে পারিবেন; এবং তিনি কর্পোরেশনের নিয়মিত কার্যে কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি না করিয়া যত দূর সম্ভব উক্ত কার্য সম্পাদনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ কর্পোরেশনের তহবিল হইতে ব্যয় করিতে পারিবেন।’ করপোরেশন এলাকায় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠিত হলে সেটিকে প্রাথমিক কার্য পরিচালনার জন্য ঋণ দেওয়ার ক্ষমতাও করপোরেশনের রয়েছে। এ ছাড়া করপোরেশন প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণও নিতে পারে। সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়েরও সে ক্ষমতা নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সিটির অভিভাবক হিসেবে ধরা হয় সিটি করপোরেশনকে। তবে মাত্র ২০টির মতো সেবা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তাদের। আর এসব সেবার মধ্যে বেশির ভাগই দাপ্তরিক। সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ফুটপাত নির্মাণ এবং সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়কবাতি রক্ষণাবেক্ষণ, মশা নিধন, কবরস্থান ও শ্মশান ব্যবস্থাপনার মতো হাতেগোনা কয়েকটি দৃশমান সেবা দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন, নাগরিক সনদ বিতরণ, আবাসিক কর আহরণের মতো দাপ্তরিক সেবাও দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে রাজধানীতে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে থাকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত ও অপসারণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

No comments:

Post a Comment