স্থায়ী একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে যুবকের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের হেফাজতে নেয়াসহ ২৬ দফা সুপারিশ করেছে সরকারি কমিটি। একই সঙ্গে মানি লন্ডারিং আইনে বেসরকারি সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। বাতিল করতে বলা হয়েছে যুবক ও তার অন্যসব সংস্থার লাইসেন্স। যুবকের ব্যাপারে গঠিত সরকারের কমিটি তাদের রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে। আজ বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে এ রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।
রিপোর্টে যুবকের মতো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে জনগণের অর্থ ও সম্পদ হাতিয়ে নিতে না পারে সেজন্য কঠোর আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে কোম্পানি আইন, সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন আইন সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয় ওই রিপোর্টে। এ ধরনের সংগঠনের কোনো অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যাতে না যান সে বিষয়েও সুপারিশ করা হয়। যুবকের তিন লাখ গ্রাহকের আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও সব সম্পত্তির ব্যাপারে সুরাহা করতে ২১ আগস্ট ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (পরিচালক বাণিজ্য সংগঠন) মো. আবদুল মান্নানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠিত হয়। টানা তিন মাস কাজ করে ওই কমিটি তাদের রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে। চলতি সপ্তাহে এটি জমা দেয়ার সম্ভাবনা আছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান মো. আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, যুবকের ব্যাপারে এর আগে দুটি অস্থায়ী কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। ওই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে এ কমিটি তাদের সুপারিশ তৈরি করেছে। সুপারিশ তৈরির সময় গ্রাহকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় মাথায় রেখেই কাজ করেছেন কমিটির সদস্যরা। তিনি বলেন, আজ বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে কমিটির সদস্যরা রিপোর্ট জমা দেবেন। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, পৃথক আইন দিয়ে একটি স্থায়ী কমিশন বা সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে। ওই কমিশন যুবকের সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেয়া, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা ও বিক্রি করে অর্থ প্রকৃত গ্রাহকদের মূল পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিদ্যমান কোম্পানি আইনে এ নতুন ধারা সংযোজন বা নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগের জন্য আইন ও নীতিমালা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গ্রাহকদের হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের জন্য দায়ী শনাক্তকৃত ৪০ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা এবং গ্রাহকদের দায়ের করা মামলা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন জেলায় আইনি সহায়তা কমিটি গঠন ও বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে কাজ করবে। স্থায়ী কমিশন বিভিন্ন স্থানে যুবকের বেদখল বা বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত প্রশাসককে কাজ করার ক্ষমতা দেবে। যাতে প্রশাসক উদ্ধারকৃত লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতে পারে সে বিষয়ে সহায়তা করবে। যুবক সংস্থার অবশিষ্ট সম্পদ যাতে বেহাত হতে না পারে সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে প্রশাসকের হাতে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, মামলাধীন জমি, বিকে টাওয়ার নির্মাণ, আরটিভির শেয়ার বিক্রি ও টাকা লেনদেন, ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শেয়ারের টাকা লেনদেন, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের বকেয়া ভাড়া নিয়ে দ্বিপাক্ষিক বিরোধ চলছে। এক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে কমিশন এ বিরোধগুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বিচারাধীন মামলা বাধা হবে না। এ উদ্দেশ্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বা খ্যাতনামা ব্যক্তিদের দিয়ে বোর্ড অব অরবিট্রেশন গঠন করতে পারে। এতে পাওনাদার গ্রাহকদের অর্থ পরিশোধের একটি ব্যবস্থা হবে। যুবক বেআইনিভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় ভবিষ্যতে গ্রাহকদের দায় পরিশোধের মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সুদবিহীন শুধু আসল টাকাই পরিশোধ করবে। যুবকের মতো প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠানের অপকৌশল থেকে নিরীহ মানুষকে সুরক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রচার মাধ্যমে নিয়মিত সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করার জন্য কমিশন কাজ করবে। কমিটির রিপোর্টে যুবকের মতো অপরাধকে কোনো নতুন আইন দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে বিশেষ বেঞ্চ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের দ্রুত বিচারের জন্য মানি লন্ডারিং আইনে বিচার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের ২১ ধারা সংশোধনের প্রয়োজন হবে। কারণ ওই ধারায় শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগের বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে আইন সংশোধন করে জেলা প্রশাসক, উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বা আদালত, ট্রাইব্যুনাল উপযুক্ত মনে করে সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থাকে দায়িত্ব দিতে পারে। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক থেকে নিবন্ধন নিয়ে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে অনেক কোম্পানি। তাই সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন আইন ১৮৬০, কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সংশোধন করা যেতে পারে। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও লেজিসলেটিভ বিভাগের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। জানা গেছে, যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) প্র্রতারণার মাধ্যমে ২৫৮৮ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। বিপুল পরিমাণ ওই অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয় ৩ লাখ ৩৭শ’ গ্রাহকের কাছ থেকে। বর্তমান যুবকের সারা দেশে ৯১টি জমি, ১৮টি বাড়ি ও ১৮টি কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি টিভি চ্যানেল আরটিভির ৫৭ শতাংশ শেয়ার কেনা হয় গ্রাহকের টাকায়। কাঁচপুরে ৮৭৮ শতক জমি, রাজধানীর পল্টনে সাড়ে ১৮ শতাংশ জমিতে নির্মিত টাওয়ার, পল্টনের ৫৩/১ ঠিকানায় সাড়ে ২১ শতক জমি ও ৪৩০ তেজগাঁও ঠিকানায় সাড়ে ৪৯ শতক জমি, চট্টগ্রাম পতেঙ্গা বিমানবন্দরের পাশে প্রায় ৪০ বিঘা, সাভার মডেল টাউন এক ও দুই নম্বর, মাদারীপুর চক্ষু হাসপাতালের সামনেও সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেঘনা সি ফুড মিল এবং পিরোজপুরেও জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন নিয়ে প্রায় ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করে। ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক তদন্তে গ্রাহকদের প্রতারণার ঘটনা বেরিয়ে আসে। ওই সময় যুবকের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে। পরে ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়সীমা ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে যুবক তা করেনি। পরে যুবকের গ্রাহকদের জমাকৃত অর্থ পরিশোধ ও হয়রানি বন্ধ, সম্পত্তি হস্তান্তর স্থগিতাদেশ ও প্রশাসক নিয়োগ করে স্থায়ী সমাধানের জন্য ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশনের রিপোর্টে স্থায়ী কমিশন গঠনের সুপারিশ ছিল। পরে সরকার নতুন করে ২০১১ সালে দুই বছর মেয়াদে কমিশন গঠন করে।
No comments:
Post a Comment