তাইজুল ইসলামের বল টেন্ডাই চাতারার প্যাডে আঘাত করার পর আম্পায়ারের আঙুল তোলার জন্য হাতটা নড়তেই একসঙ্গে স্টাম্পের ওপর হাম
লে পড়লেন চার-পাঁচজন! দুই ধারের ছয়টা স্টাম্প ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল সবাই ঘিরে হাতে নাক চেপে ধরা শুভাগত হোমকে। পরে মুশফিকুর রহিম আশ্বস্ত করেছেন, ‘স্টাম্প লেগে নাকে ব্যথা পেয়েছিল। এখন ঠিক আছে।’ নিজে দুটি স্টাম্প নিলেও সিরিজ জয়ের কোনো স্মারক রাখেননি বাংলাদেশের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক, ‘ওগুলো অন্যদের দিয়ে দিয়েছি।’ সাফল্য বুঝি এভাবেই মহত্ত্ব বয়ে আনে। সেঞ্চুরি এবং ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়ে মহানায়ক সাকিব আল হাসানও বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর পরিবর্তে জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট নিতে পারতেন তাইজুল ইসলাম কিংবা যুবায়ের হোসেন। তারও আগে প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করেও আড়ালে থেকে যান তামিম ইকবাল, অকারণ প্রচারণা আর ভালো লাগে না তাঁর। দলের জন্য ‘কন্ট্রিবিউট’ করাই একমাত্র লক্ষ্য- সিরিজ জয়ের আনন্দধারায় বসেও সবাইকে এটা মনে করিয়ে দিয়েছেন মুশফিক-সাকিব। তারই প্রতিচ্ছবি হতে পারে মাহমুদ উল্লাহর রানের ধারাবাহিকতায় ফেরা, মমিনুল হকের নিজের কাছেই নিজের দাবি বাড়িয়ে দেওয়া কিংবা খুলনার ফ্ল্যাট উইকেটেও রুবেল হোসেনের বোলিং দেখে সাবেক কোচ ডেভ হোয়াটমোরের চমকে যাওয়া। সব মিলিয়ে এ জয় সাকিব এবং বাংলাদেশের আরো ১০ ক্রিকেটারের। কৌতূহল ছিল ২৬৬ রানের ‘লিড’টাকে কোথায় নিয়ে ইনিংস ঘোষণা করবেন মুশফিকুর রহিম। সেই কৌতূহল মিটেছে ১৯.৫ ওভারে বাংলাদেশ ৪৭ রান তোলার পর। এতে জিম্বাবুয়ের জন্য টার্গেটটা ৩১৪ রানের হয়ে যাওয়ায় মাহমুদ উল্লাহর আরেকবার সেঞ্চুরি ‘মিস’ করার আক্ষেপটা ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। তবে মাত্র ৬৮ ওভারে জিম্বাবুয়েকে অলআউট করা যাবে কি না, এ নিয়ে সংশয়বাদীদের আক্ষেপ ছিল, একটু কি দেরিতেই ইনিংস ঘোষণা করলেন মুশফিক? বাংলাদেশ ইনিংস ঘোষণা করার আধাঘণ্টা পর লাঞ্চের টেবিলে বসার আগেই সেই আক্ষেপ ধুয়েমুছে সাফ! পঞ্চম দিনের বিচারে উইকেটে স্পিনারদের বল চরকির মতো ঘোরেনি ঠিকই, তবে বাউন্সের ওঠা-নামা নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ানদের। তাই নতুন বলে দুই বাঁহাতি তাইজুল ও সাকিবকে লেলিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। তাতে মাত্র ১৮ রানে জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনারকে ফিরিয়ে দিয়ে মধ্যাহ্নভোজটা উপভোগ্য করেছেন তাইজুল ও সাকিব। ক্রিকেট দলীয় খেলা, তাই সাফল্য-ব্যর্থতাও দলীয়। কিন্তু দলীয় সাফল্যের ভিড়েও কেউ এগিয়ে থাকেন। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ ক্রিকেটার এমন কিছু করেন, ইতিহাসের ছাত্রদের মনেও দাগ কেটে যায়। খুলনার পাঁচটা দিন প্রতিনিয়তই সাফল্যের এ সিঁড়ি থেকে পরেরটিতে তুলে নিয়ে গেছে সাকিব আল হাসানকে। কাল লাঞ্চের পর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের শেষ ধাপে চড়া শুরু তাঁর। বিরতির পর প্রথম বলেই ব্রেন্ডন টেলরকে ফিরিয়ে দেন সাকিব। সাকিব দুই উইকেট নিলে সবাই অপেক্ষায় থাকে তাঁর তৃতীয় সাফল্যের। কিন্তু প্রথম ইনিংসে বিস্তর ‘ঝামেলা’ করা হ্যামিল্টন মাসাকাদজা ও রেজিস চাকাভা যে দ্বিতীয়বারেও জ্বালাচ্ছিলেন খুব! প্রথমজন পঞ্চম দিনের উইকেটে অবলীলায় ছক্কা হাঁকিয়েছেন সাকিবকেও। প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান চাকাভাকেও প্রতিরোধের দেয়াল তুলতে দেখে একটু কি হতাশ হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ? মুশফিক অবশ্য অস্বীকার করেছেন, ‘কখনোই মনে হয়নি যে আমরা ম্যাচটা জিততে পারব না।’ যদিও তিনি মাসাকাদজা-চাকাভা জুটি ভাঙার জন্য শুভাগতের খণ্ডকালীন অফ স্পিন দিয়েও চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। সাফল্য এসেছে সেই বিশেষজ্ঞ বোলারের হাত থেকেই। চাকাভাকে ফিরিয়ে দিয়ে ৭০ রানের এ জুটি ভাঙেন তরুন লেগ স্পিনার যুবায়ের হোসেন। তবে মুশফিকের বিশ্লেষণে যুবায়েরের সেরা ডেলিভারি হলো ক্রেইগ আরভিনকে আউট করা বলটি। অধিনায়ক মুশফিক এবং ম্যাচের নায়ক সাকিবের বিস্তর প্রশংসা পেয়েছেন তাইজুল ইসলামও। অস্বাভাবিক নিচু হয়ে যাওয়া বলে ম্যালকম ওয়ালারকে বোল্ড করা তাইজুলের তৃতীয় শিকারের মধ্য দিয়েই পর্দা নামে এ সিরিজের খুলনা এপিসোডের, যে ম্যাচের আগে-পরে-মাঝে একটা নাম এসেই যাবে অবধারিতভাবে। তিনি সাকিব আল হাসান। দ্বিতীয় সেশনে প্রতিরোধ গড়ায় জিম্বাবুয়েকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই মাসাকাদজাকে আউট করাই যাচ্ছিল না! সেই প্রতিরোধও ভেঙেছে, ভেঙেছেন সাকিবই। ওটা তাঁর তৃতীয় শিকার। এ তো আর নতুন কিছু নয়, এ দেশের পক্ষপাতটা বহু আগেই নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন সাকিব। আর খুলনা তো তাঁর নিজের শহর। তাই তিন কখন পাঁচ হবে- সব ভুলে এই ‘কাউন্টডাউন’ শুরু হয়ে যায় গ্যালারি এবং সম্ভবত সারা দেশেই। খুব বেশি সময় নেননি, মাত্র ৭ বলের ব্যবধানে তিনকে পাঁচ করেছেন সাকিব। সেটা ছয়ও হতে পারত, যদি তাঁর বলে টেন্ডাই চাতারার ক্যাচটা না ফেলতেন শাহাদাত হোসেন। এ ভুলটা না হলে সাকিবের হাত দিয়েই শেষ হতো খুলনা টেস্ট। অনিশ্চয়তার দোলায় পাঁচ দিন দুলে শেষ হওয়া ক্লাসিক্যাল টেস্ট ম্যাচটির ‘অতৃপ্তি’ বলতে এটুকুই। অবশ্য অতৃপ্তিই তো বাঁচিয়ে রাখে ক্ষুধা। সাকিব তো আর এমনি এমনি বলেননি যে, আরো উন্নতিই তাঁর লক্ষ্য। সেটা করতে পারলে ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু হবে বলেই বিশ্বাস সাকিবের। এ বিশ্বাস সম্ভবত পুরো দেশেরই।
No comments:
Post a Comment