Saturday, November 8, 2014

মুখ বুজে না থেকে তালাকের পথে হাঁটছে নারীরা:কালের কন্ঠ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই মন দেওয়া-নেওয়া শুরু। পড়াশোনা শেষে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে বাদ সাধে উভয় পক্ষের পরিবার। প
রিবারের আপত্তি আমলে না নিয়ে বিয়ে করে তারা। সুখেই কাটছিল ছোট্ট সংসার, বছর ঘুরতেই ঘরে আসে নতুন অতিথি। তবে সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, সাজানো সংসার ঘিরে জমতে থাকে কালো মেঘ। ছেলেটি গোপনে আরেক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। মাতাল হয়ে বাসায় ফেরা শুরু করেন, কিছু বললেই স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে একদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন স্ত্রী, স্বামীকে তালাক দেন। সন্তানসহ চলে যান বাবার বাড়ি। শুধু এ দম্পতি না, তাঁদের মতো রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত প্রায় পাঁচ বছরে শুধু ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৫৪ হাজার ৪৯৫টি। এর মধ্যে কেবল গত ১০ মাসেই বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২৫ হাজার ৪৮৮টি। এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ২০ হাজার বিচ্ছেদের আবেদন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) গবেষণায় উঠে এসেছে এ চিত্র।  বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন গবেষণা করছে ১৯৯৫ সাল থেকে। করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণ অংশে বিভক্ত হওয়ার পরও তা জারি আছে। প্রতিবছর জুনে তারা গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, যেসব আবেদন ইতিমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে পরকীয়ার জের ধরে। আবেদনকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের তুলনায় নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদের সংখ্যা বেশি। আবেদনকারীদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের, মধ্যবিত্ত ৩৮ শতাংশ এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের রয়েছে ১৫ শতাংশ। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্বামী-স্ত্রীর মানসিক দূরত্ব, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মাদকাসক্তি ও যৌতুক এবং অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে বিচ্ছেদের হার বাড়ছে। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেশি। তালাক চেয়ে নারীদের আবেদন করার হার বেশি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী। আগের মতো মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য না করে এখন তারা তালাকের পথ বেছে নিচ্ছে।  অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেছেন, সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকাসক্তি, যৌতুকসহ নানা কারণেই ঘটছে বিবাহ বিচ্ছেদ। তাঁরা বলেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি হলে পরিবারের সবাই মিলে তা মীমাংসা করা উচিত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি, কোনো বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে তা দূর করতে হবে।  উভয় সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, মূলত ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭(১) ধারা অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ায় করপোরেশনের সালিসি বোর্ডের কর্মকর্তারাও বেকায়দায় পড়ছেন। পরিস্থিতি উত্তরণে দুই সিটি করপোরেশনে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে অঞ্চলভিত্তিক সালিস বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা সালিসি পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।  সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, সালিসি পরিষদের চেয়ারম্যান সমঝোতার জন্য প্রথম দফায় উভয় পক্ষের কাছে নোটিশ পাঠান। প্রথম নোটিশ পাঠানোর সময় থেকে তিন মাসের মধ্যে যদি উভয় পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়, তবে পরিষদের চেয়ারম্যান তালাক কার্যকরের জন্য পদক্ষেপ নেন। পাঁচ বছরে সাড়ে ৫৪ হাজার বিচ্ছেদ : গত প্রায় পাঁচ বছরে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় ৫৪ হাজার ৪৯৫টি বিচ্ছেদের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে সাত হাজার ৭৮৯টি, ২০১১ সালে পাঁচ হাজার ৩৩২টি, ২০১২ সালে সাত হাজার ৬৭২টি, ২০১৩ সালে আট হাজার ২১৪টি। আর গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫ হাজার ৪৮৮টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ২০ হাজার আবেদন। সিটি করপোরেশনের গবেষণা অনুযায়ী, তালাকের ক্ষেত্রে শতকরা ৭০টি আবেদনই করছে নারীরা। বিচ্ছেদের কারণের মধ্যে অন্যতম পরকীয়া সম্পর্ক। আবেদনকারী নারীদের মধ্যে শতকরা ৮৭ জন বলেছে, তারা কোনো না কোনো সময় স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৬৭ শতাংশ নারী বলেছে, স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা। আবার বিচ্ছেদ চাওয়া ৪৯ শতাংশ স্বামী বলেছে, স্ত্রীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা।  পুলিশের ওয়েলফেয়ার শাখাও অপরাধপ্রবণতা রোধে নিজ উদ্যোগে গবেষণা চালায়। সিটি করপোরেশন ও পুলিশের জরিপে বলা হয়েছে, তালাকের আবেদন করা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই গার্মেন্টকর্মী। রিকশাচালকও আছে। সংসারের তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ঝগড়া বাধে তাদের। ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থাকে না, যৌতুকের কারণে স্ত্রীর ওপর চালানো হয় নির্যাতন। ফলে কয়েক মাস সংসারের পরই একে অপরকে তালাক দেয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অর্থনৈতিক টানাপড়েন নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল হয়, দানা বাঁধে সন্দেহ। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা আবেগী হয়। স্বামীর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে স্ত্রীরা একপর্যায়ে স্বামীকে তালাক দেয়। একই কারণে স্বামীরাও স্ত্রীকে তালাক দেয়। উচ্চবিত্ত পরিবারে জীবনযাত্রার ধরন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে টানাপড়েন চলে। একপর্যায়ে ঘটে যায় তালাক। সালিসি পরিষদের কার্যক্রম : ঢাকা সিটি করপোরেশনের  (উত্তর ও দক্ষিণ) সালিসি বোর্ড-১-এর অবস্থান সায়েদাবাদের গোলাপবাগ মাঠ এলাকায়। যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শ্যামপুর, কদমতলী ও জুরাইন এলাকার লোকজন এ অঞ্চলের সহায়তা নিচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে ৯ তলার পূর্ব পাশে সালিসি বোর্ডের অঞ্চল-২-এর অফিস। এ অফিসে বংশাল, কোতোয়ালি, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজারসহ পুরান ঢাকার বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা নেওয়া হয়। আজিমপুর এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছে অঞ্চল-৩-এর কার্যালয়। রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ এলাকা নিয়ে অঞ্চল-৪-এর কার্যালয়। পান্থপথ, হাতিরপুল, ধানমণ্ডি, গ্রীন রোডসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছে অঞ্চল-৫-এর অফিস। নগর ভবনের ৯ তলায় পশ্চিম পাশে অঞ্চল-৫-এর অফিস। তেজগাঁও, ফার্মগেট, তেজতুরী বাজারসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে কারওয়ান বাজারে রয়েছে অঞ্চল-৬-এর অফিস। পল্লবী, শাহ আলীসহ আশপাশের এলাকার আবেদন জমা নেওয়া হয় মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে টাউন হলের পেছনে অঞ্চল-৭-এর অফিসে। মিরপুর গ্রামীণ অফিস-সংলগ্ন অঞ্চল-৮-এর কার্যালয়ে শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, আগারগাঁও ও গাবতলী এলাকার আবেদন জমা নেওয়া হয়। গুলশান, বাড্ডা, শাহজাদপুর, বনানী, বারিধারা ও ডিওএইচএস নিয়ে গঠিত হয়েছে অঞ্চল-৯-এর কার্যালয় এবং উত্তরার নগর ভবনে স্থাপিত অঞ্চল-১০-এর কার্যালয়। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা কালের কণ্ঠকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, অথনৈতিক দুর্বলতা, পরকীয়া, যৌতুকসহ নানাবিধ কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। মূলত বিবাহ বন্ধনে দুর্বলতা, কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের কারণে বিচ্ছেদ হচ্ছে। গ্রাম থেকে একটি মেয়ে যখন শহরে আসে তখন সে অনেক সংগ্রাম করে এবং সে একজন সঙ্গী বেছে নেয়। কিন্তু কয়েক মাস পর দেখা যায়, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পেরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তখনই তারা পরস্পরকে ভুল বুঝে তালাক দেয়। তা ছাড়া মোবাইল ফোন বা ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তিও অনেকখানি দায়ী। মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত পারিবারিক কলহের জের ধরে তালাকের ঘটনা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে নারীরাই বেশি তালাক দিচ্ছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।’ এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও আয়ের উৎস বেড়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি মূল্যবোধ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রামের চেয়ে শহরে তালাকের প্রবণতা বেশি। সমস্যা তৈরি হলে পারিবারিকভাবেই এর সুরাহা করতে হবে। কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকে অগ্রাধিকার ভূমিকা পালন করতে হবে।

No comments:

Post a Comment