Friday, November 28, 2014

৮ দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ চুক্তিতে সার্কে আলো:কালের কন্ঠ

অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ জ্বালানি (বিদ্যুৎ) সহযোগিতাসংক্রান্ত রূপরেখা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গতকাল বিকেলে কাঠমাণ্ডুর সিটি হলে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ১৮তম শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে সার্ক নেতাদের উপস্থিতিতে সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। সদস্য দেশগুলো একমত হতে না পারায় গত বুধবার সম্মেলনের উদ্ব
োধনী অনুষ্ঠানে এ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য নির্ধারিত পর্ব থাকা সত্ত্বেও তা করা যায়নি। মোটরযান চলাচল ও রেল যোগাযোগ চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ আরো আগেই ভেস্তে যায়। তবে গতকাল শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে এ চুক্তি দুটি নিয়েও আশার কথা বলেছেন সার্ক সভাপতি ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। তিনি বলেন, মোটরযান চলাচল ও রেল যোগাযোগ চুক্তি চূড়ান্ত করতে তিন মাসের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠান শেষে ঘোষিত ৩৬ দফা কাঠমাণ্ডু ঘোষণাতেও তা স্থান পেয়েছে। উল্লেখ্য, গত রবিবার ও সোমবার সার্কের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকেই ওই তিনটি চুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এরপর এবারের সম্মেলনে অন্তত একটি চুক্তি হলেও স্বাক্ষরের জন্য জোর তৎপরতা চালান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বৈঠক করলেও ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ নেতাদের আলোচনায় ফল আসে। অবশেষে করমর্দন : নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে এবারের সার্ক সম্মেলনে মনোযোগের কেন্দ্রে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। চিরবৈরী দেশ দুটির সম্পর্কে সম্প্রতি অবনতির কারণে দুজনের কথা না বলার বিষয়টিতে সম্মেলনের সাফল্য নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গতকাল সম্মেলনের শেষ দিনে দুই প্রধানমন্ত্রী বিভেদ ভুলে করমর্দন করেন। এ সময় অন্য নেতারা হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। ছবি : এএফপি জানা গেছে, মোটরযান চলাচল ও রেল যোগাযোগ চুক্তিটি এবারের সম্মেলনে স্বাক্ষরের উদ্যোগ বাদ দেওয়ার পর বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে আপত্তি ছিল কেবল পাকিস্তানের। গতকাল সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিনে আট দেশের শীর্ষ নেতাদের অবকাশ যাপনের (রিট্রিট) জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কাঠমাণ্ডুর অদূরে ধুলিখেল রিসোর্টে। সেখানেই শীর্ষ নেতাদের আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষরের জটিলতা কাটে। সূত্র জানায়, গতকালের রিট্রিট সেশনে বিদ্যুৎ চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ছাড়া অন্য সব সার্ক নেতা ছিলেন এক পক্ষে। তাঁদের সবার মত ছিল, চুক্তিটি স্বাক্ষর করা উচিত। এরপর নওয়াজ শরিফ চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে তাঁর দেশের সম্মতির কথা জানান। তিন বছর পর এবার অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আকর্ষণ- প্রত্যাশিত তিন চুক্তির সব কটিই ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় সম্মেলন অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ওই চুক্তি তিনটির সব কটিই আঞ্চলিক সংযোগকে (কানেক্টিভিটি) উৎসাহিত করবে। কিন্তু শেষবেলায় বিদ্যুৎ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এবারের সম্মেলন নিয়ে হতাশা কিছুটা হলেও কাটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জানা গেছে, বিদ্যুৎ চুক্তিটি রূপরেখা চুক্তি হওয়ায় এর আওতায় আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় অনেক উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। চুক্তিতে আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। ফলে এক দেশের বিদ্যুৎ সহজেই অন্য দেশ কিনতে পারবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এখন বিদ্যুৎ আমদানি করছে। ভুটান ও নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে তা আমদানি করার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ। এসব দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য এই চুক্তিটি সহায়ক হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত অক্টোবরে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সার্ক দেশগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ের পঞ্চম বৈঠকে ‘সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন’-এর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কাঠমাণ্ডুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এটি এক ধরনের ঐকমত্য। এর মাধ্যমে আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিদ্যুৎ আমদানি-রপ্তানি হলে মূল্য নির্ধারণ হবে দুই পক্ষের সম্মতিতে। এই চুক্তি আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা (গ্রিড) গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। এটি করা হবে ‘নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ’ ব্যবস্থার আওতায়। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এতে পারস্পরিক সহায়তা করবে। এই চুক্তির আওতায় কোনো দেশ ইচ্ছা করলে ছয় মাসের নোটিশ দিয়ে তা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করতে পারবে। পাঁচ বছর পর চুক্তি পর্যালোচনা করা হবে। জানা গেছে, চুক্তিটি বাস্তবায়নের আগে সদস্য দেশগুলোর অনুসমর্থন করতে হবে। এদিকে আগামী তিন মাসের মধ্যে যোগাযোগ খাতের চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত করার ঘোষণার বিষয়ে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, সার্ক সচিবালয় যোগাযোগমন্ত্রীদের বৈঠক ডাকবেন। সেটি কোথায় অনুষ্ঠিত হবে তা আগামী দিনগুলোতে ঠিক করা হবে। তবে সাধারণত এ ধরনের চুক্তি শীর্ষ সম্মেলনেই স্বাক্ষরিত হয়ে থাকে। তাই চুক্তি দুটি স্বাক্ষরের জন্য আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন সমাপ্ত : গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাঠমাণ্ডুর সিটি হলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম ও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দেশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নেপাল সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান। নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা সার্ক এ অঞ্চলের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন। এর আগে বুধবার সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাসহ প্রায় সব সার্ক নেতাই প্রত্যাশার তুলনায় সার্কের পিছিয়ে থাকার কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা এ সংস্থাকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করারও আগ্রহ প্রকাশ করেন। অসুস্থতার কারণে ধুলিখেলে যাননি শেখ হাসিনা : গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্কের শীর্ষ নেতাদের পূর্বনির্ধারিত অবকাশ যাপন (রিট্রিট) অনুষ্ঠানে যাননি। কাঠমাণ্ডুর অদূরে ধুলিখেল রিসোর্টে ওই রিট্রিট অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতায় শেখ হাসিনা রিট্রিটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেখানে অন্য সার্ক নেতারা তাঁর অসুস্থতার বিষয়ে খোঁজ নেন ও সুস্থতা কামনা করেন। গতকাল সন্ধ্যায় সার্ক নেতারা নেপালের প্রেসিডেন্ট ড. রামবরণ যাদবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর আয়োজিত নৈশ ভোজে অংশ নেন। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় পৌঁছাবেন। হাসিমুখে করমর্দন মোদি-নওয়াজের : সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজেদের মধ্যে কোনো বৈঠক করেননি, তবে গতকাল ধুলিখেলে রিট্রিট সেশনে নওয়াজের সঙ্গে মোদি শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। দ্বিপক্ষীয় কোনো ইস্যুতে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়নি। গতকাল সকালে সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানের পর মঞ্চে সার্কের সদস্য দেশগুলোর নেতাদের প্রায় সবাই নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলছিলেন। সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ কথা বলছিলেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের সঙ্গে। এরপর নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালার উদ্যোগে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে করমর্দন করেন নওয়াজ শরিফ। মুহূর্তেই তুমুল করতালি আসে মঞ্চের সামনে থাকা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে। নওয়াজ ও মোদি বেশ কিছু সময় হাস্যোজ্জ্বল মুখে করমর্দন করেন। অথচ গত বুধবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরিফ বক্তব্য রাখতে যাওয়ার সময় নরেন্দ্র মোদি সম্মেলনের ফাইলপত্র দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তাঁর দিকে ফিরেও তাকাননি।

No comments:

Post a Comment