এ কেমন নিষ্ঠুরতা! প্রেম-ভালোবাসা আর বিয়ের জন্য একটি তরতাজা যুবকের হাত-পা ও চোখ খোয়া গেল। অন্ধত্ব আর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে তাকে বয়ে বেড়াতে হবে বাকিটা জীবন। এ করেই খ্যান্ত হতে পারেনি নিষ্ঠুর লোকগুলো। হাতে অস্ত্র ধরিয়ে ওই যুবককে দেয়া হলো পুলিশের কাছে। পুলিশও কোনো তদন্ত না করেই মনিরের বিরুদ্ধে একটি মামলা নিয়ে নিলো। অসহায় ওই যুবকটি এখন পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আর তার পরিবারের
সদস্যরা যুবকটিকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একই সাথে এই নিষ্ঠুর আচরণের বিচারও চাইছেন। ঘটনাটি ঘটেছে ঝালকাঠী সদর উপজেলার ইছালিয়া গ্রামে। নিষ্ঠুরতার শিকার যুবকটির নাম মনির হোসেন (২৪)। মনির ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানির ড্রাইভার। বাড়ি ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার আঙ্গারিয়া গ্রামে। বাবার নাম মনসুর আলী হাওলাদার। মনিরের ভাই জানান, ঝালকাঠীর ইছালিয়া গ্রামের জাহাঙ্গিরের মেয়ে নাইটির সাথে মোবাইল ফোনে মনিরের পরিচয়। এই সূত্র ধরেই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক। ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট পরিবারের কাউকে না জানিয়ে মনির নাইটিকে বিয়ে করে। বিয়ের পর মনিরের সব সঞ্চিত অর্থ, এমনকি তাদের দাদীর রেখে যাওয়া গয়নাও নাইটিকে দিয়ে দেয় মনির। নাইটির তখন এইচএসসি পরীক্ষা থাকার কারণে মনির তাকে তার বাড়িতেই রেখে আসে। এদিকে কয়েক মাসের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হলে নাইটির পরিবার থেকে মনিরকে অব্যাহত হুমকি দিতে থাকে। মনির কিছুতেই তার স্ত্রীকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। কিছু দিন আগে নাইটির বাবা জাহাঙ্গির তার মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেন। মনির বিষয়টি নাইটির বাবা জাহাঙ্গির এবং মামা জসিমকে জানাতে চাইলে তারা বিষয়টি মীমাংসার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী গত ১৩ অক্টোবর মনির ঢাকা থেকে ঝালকাঠী যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনির জানান, ইছালিয়া গ্রামে নাইটিদের বাড়ির সামনে যখন পৌঁছেন তখন দুপুর। সেখানে কিছু অপরিচিত লোক দেখতে পেয়ে তিনি ভড়কে যান। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু নাইটির বাবা ও মামা জসিম তাকে ধরে ফেলেন। এরপর বেশ কয়েকজন মিলে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করেন। জসিমের বাড়ির মধ্যে নিয়ে তাকে মারধর করা হয়। মনির বলেন, তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। চিৎকার করছিলেন তিনি। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আশপাশের কেউ শুনতে পারছিলেন না। প্রায় ১০-১২ জন লোক মিলে মনিরকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে। এদের মধ্যে নাইটির মামা জসিম মনিরের দুই চোখে খেজুর কাঁটা এবং সিরিঞ্জ ঢুুকিয়ে চোখ দু’টি নষ্ট করে দেয়। মনিরের এক হাত এবং এক পা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় তারা। ইট দিয়ে থেতলে দেয়া হয় তার পুরুষাঙ্গ। অচেতন অবস্থায় তারা মনিরকে বাইরে ফেলে রাখে। পরে পুলিশকে খবর দিয়ে অচেতন অবস্থায় তাকে তুলে দেয়া হয় পুলিশের হাতে। সাথে দিয়ে দেয়া হয় একটি পিস্তল এবং পাঁচ রাউন্ড গুলি। স্থানীয় ইউপি মেম্বর হেলাল মল্লিক ও দফাদার কবির হোসেন তাদের সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হেলাল মল্লিকই বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ওয়ারেচ আলীকে অবহিত করেন ও পুলিশকে জানাতে বলেন। তাদের ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অচেতন অবস্থায় মনিরকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। পরে সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পুলিশি হেফাজতে হ্যান্ডকাপ পরানো মনির এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ইতোমধ্যে তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়। উন্নত চিকিৎসা না হলে বাঁ পা-ও কেটে ফেলতে হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে থানায় দায়েরকৃত মামলায় জসিম উল্লেখ করেছেন, বরিশালের সৈয়দ কনক নামের এক যুবকের সাথে তার ভাগ্নির বিয়ে হয়েছে। কনকের সাথেই নাইটি ঘর-সংসার করছে। মনিরের সাথে আগে নাইটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গোপনে মনির তার ভাগ্নির সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করতেই মনির তার দিকে পিস্তল তাক করে। তখন তিনি মনিরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ঝাপটে ধরেন। এ সময় এক রাউন্ড গুলি বের হয়ে তার কানের কাছ দিয়ে চলে যায়। মামলার এজাহারে দাবি করা হয়েছে উত্তেজিত জনতা মনিরকে গণধোলাই দিয়েছে। এতে সে জখম হয়েছে। গতকাল জসিমের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কী ঘটেছে তা কোর্টে প্রমাণ হবে। এদিকে ঘটনার ব্যাপারে মনিরের বাবা মনসুর আলী আদালতে একটি মামলা করেছেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল হামিদ মল্লিক সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি মনিরকে জসিমের বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছেন। থানার এসআই জাকির বলেছেন, স্থানীয় লোকজন গুরুতর জখমপ্রাপ্ত মনিরকে একটি পিস্তল ও পাঁচ রাউন্ডগুলিসহ তাদের কাছে সোপর্দ করেছে। এদিকে ঝালকাঠী সদর থানার ওসি নীল মনি চাকমা বলেছেন, বিষয়টি তদন্ত চলছে। অস্ত্রটির ফিঙ্গার প্রিন্ট পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
No comments:
Post a Comment