ভরা পূর্ণিমায় ধবল জ্যোৎস্নায় যখন ভেসে যায় চরাচর তখনো অন্ধকারে ছেয়ে থাকে রাজধানীর অলিগলি। কারণ গায়ে গায়ে হেলান দিয়ে দাঁ
ড়িয়ে থাকা গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো জ্যোৎস্নার পথ আটকে দাঁড়ায়। কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হওয়া রাজধানীর সব এলাকায়ই চোখে পড়ে এমন অসংখ্য অট্টালিকা। অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমণ্ডি, বারিধারা, গুলশান ও বনানী এলাকায় এমন আবাসিক অট্টালিকাগুলোয় ফ্ল্যাট আছে লক্ষাধিক। একেকটি ফ্ল্যাটের দাম কয়েক কোটি টাকা। এ হিসাব আবাসন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব)। বন্দরনগর চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকাগুলোতেও একেকটি ফ্ল্যাটের দাম কোটি টাকার ওপরে। এ তো গেল ফ্ল্যাটের কথা, রাজধানীর রাজপথগুলোও এখন দাপিয়ে বেড়ায় বিলাসবহুল সব গাড়ি। ল্যান্ড রোভার, মার্সিডিজ Ÿেঞ্জ, বিএমডাব্লিউ, লেক্সাসসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি চোখে পড়ে হরহামেশাই। কোটি টাকার ওপরে (আমদানি শুল্কসহ) দাম- এমন প্রায় ৪৯ হাজার গাড়ি নিবন্ধিত আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে। এর বাইরেও অনিবন্ধিত অবস্থায় আছে অন্তত ৩০০ গাড়ি। এত এত দামি বাড়ি, গাড়ি- তার মানে দেশে কোটিপতির ছড়াছড়ি। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দেওয়া বার্ষিক আয়কর বিবরণী দেখলে হোঁচট খেতে হবে। চলতি করবর্ষে দুই কোটি টাকার ওপরে নেট সম্পদ আছে, এমন করদাতার সংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার ৩২৯! গত বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের কাছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর প্রশাসন থেকে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ আছে। গত ২ নভেম্বর পর্যন্ত করদাতাদের জমা দেওয়া আয়কর রিটার্নের তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। এবার গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ সময় ছিল ২ নভেম্বর। পরে তা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০১১ সালের আয়করের সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী চূড়ান্ত হিসাবে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদ আছে, এমন করদাতার সংখ্যা ছিল চার হাজার ৩০৩ জন। ২০১২ সালে ছিল চার হাজার ৮৬৫ জন এবং ২০১৩ সালে ছিল পাঁচ হাজার ১৪৫ জন। গত ২ নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশে দুই কোটির ওপরে নেট সম্পদ আছে এমন কোটিপতি সম্পদধারী বেড়েছে মোটে ১৮৪ জন। এনবিআর সূত্র জানায়, দেশের অন্য এলাকার তুলনায় গত দুই বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুই কোটি টাকার ওপরে সম্পদধারী করদাতার সংখ্যা বেশি ছিল। চলতি বারেও রাজধানী ও বন্দরনগর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। দেশে কোটিপতির সঠিক সংখ্যা জানার কোনো ভিত্তি নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে কোটি টাকার বেশি ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে এক কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা আছে ৩৭ হাজার ১৭৭টি। এর মধ্যে এক থেকে পাঁচ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ৩১ হাজার ৪২টি। পাঁচ থেকে ১০ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব আছে তিন হাজার ৬৮৭টি। ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাব আছে এক হাজার ৮৯টি। আর ৫০ কোটি টাকার ওপরে ব্যাংক হিসাব ছিল ২৪৮টি। সব হিসাবে মোট জমা রয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। আর ১৯৭৫ সালে কোটি টাকার বেশি অর্থ আছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪৭টি। তবে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও আয়কর বিবরণীতে তার ছাপ পড়ছে না কারণ তাদের মধ্যে বেশির ভাগই সম্পদের সঠিক তথ্য দেয় না। সব পেশাজীবীর লোকজনই আয়কর ফাঁকি দেয়। সবচেয়ে বেশি ফাঁকি দেন চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা। আইনজীবরাও কর ফাঁকি দেন। গত ৩০ এপ্রিল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন বলেছেন, ‘ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের ৯০ শতাংশই কর দেন না।’ কর ফাঁকি দেওয়ার তালিকায় সংসদ সদস্যরাও আছেন। গত ২০ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানায়, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে ২২৬ জনই কোটিপতি। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অন্তত ৪২ জন আয়কর দেন না। নির্বাচন কমিশনে এমপিদের জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এ দাবি করে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে দুই কোটি টাকার ওপরে নেট সম্পদধারীর সংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার ৩২৯ জন, এমন তথ্য এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছেও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বৃহস্পতিবার ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেদিনই তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটিকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিআরটিএ থেকে জরুরি ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করে কোটি টাকার ওপরে ব্যাংক হিসাবধারী এবং বিলাসবহুল গাড়ির মালিকরা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন কি না অথবা জমা দেওয়া রিটার্নে তাঁরা সঠিক তথ্য দিয়েছেন কি না তা যাচাই করবে কমিটি। রিটার্ন জমা না দিলে অথবা আয়কর বিবরণীতে তথ্য গোপন করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এনবিআর প্রচলিত আইনে মামলা করবে। অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হবে। এনবিআর সূত্র এসব তথ্য জানায়। সিআইসি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সম্পদশালীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে স্ল্যাবের আওতা ও পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বছরে ৩০ লাখ টাকার ওপরের উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের সুপার ট্যাক্স গ্রুপের আওতায় এনে ৩০ শতাংশ রাজস্ব ধার্য করা হয়েছে। নিয়মিত এ আয়করের সঙ্গে সম্পদশালীদের জন্য অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয়েছে। দুই কোটি টাকা বা তার বেশি কিন্তু ১০ কোটি টাকার নিচে সম্পদের মালিকদের নিয়মিত আয়করের সঙ্গে আরো ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হবে। আর ১০ কোটি বা তার বেশি কিন্তু ১৫ কোটি টাকার কম সম্পদের মালিকদের নিয়মিত আয়করের সঙ্গে দিতে হবে ১৫ শতাংশ এবং ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদের মালিকদের নিয়মিত আয়করের সঙ্গে আরো ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর পরিশোধ করতে হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, অতিরিক্ত কর ফাঁকি দিতেই অনেকে বিবরণীতে সম্পদের পরিমাণ কমিয়ে দেখান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোটি টাকার ওপরে যে পরিমাণ ফ্ল্যাট বা প্লট রয়েছে তার সংখ্যাই হবে কয়েক লাখ। আবার কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ির সংখ্যাও কম নয়। এনবিআরের পুরনো ধারার কাজের পদ্ধতিতে সম্পদশালীদের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয় না। তাই করদাতাদের প্রকৃত তথ্য জানতে এনবিআরের কাজের পদ্ধতিতে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হওয়া উচিত। এতে রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বাড়বে। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, আয়কর ফাঁকি দিতে রিটার্নে মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে অনেকে। লোকবলের অভাবে সেই তথ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এনবিআর থেকে যাচাই করা সম্ভব হয় না। আবার কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচার করে বিদেশে সম্পদ কিনছে অনেকে। এসব তথ্যও আয়কর রিটার্নে গোপনই থাকছে। আয়কর ফাঁকি দেওয়া অল্প কিছু করদাতাকে এনবিআর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে পারলে বাকিরা ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্নীতি করতে সাহস পাবে না। প্রসঙ্গত, ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে প্রায় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেই এখন যেকোনো বাংলাদেশি দেশটির কাছ থেকে পাচ্ছেন ১০ বছর মেয়াদি মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা। মালয়েশিয়ার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন দুই হাজার ৭৫৫ জন বাংলাদেশি। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ৪৯ হাজার বিলাসবহুল গাড়ির যে নিবন্ধন আছে তার মধ্যে মার্সিডিজ বেঞ্জই বেশি, প্রায় ২৫ হাজার। আমদানি শুল্কসহ একেকটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ও লেক্সাস গাড়ি কিনতে খরচ পড়ে চার কোটি টাকা পর্যন্ত। আর বিএমডাব্লিউ ও ল্যান্ড রোভার কিনতে খরচ পড়ে সাত কোটি টাকা পর্যন্ত। রিহ্যাব সূত্র অনুযায়ী, ধানমণ্ডিতে এখন ফ্ল্যাটের মূল্য প্রতি বর্গফুট ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা, গুলশানে ২০ থেকে ২৮ হাজার, বারিধারায় ২০ থেকে ২৫ এবং বনানীতে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়ছে ১৫ থেকে ২২ হাজার টাকা করে। এই হিসাবে এসব এলাকায় মধ্যম মানের একেকটি ফ্ল্যাটের দামই কয়েক কোটি টাকা। আয়কর ফাঁকির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই ভাবে কর ফাঁকি দেওয়া হয়। রাজস্ব কর্মকর্তাকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে এবং রাজস্ব কর্মকর্তাকে না জানিয়ে কৌশলে কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। ফাঁকি বন্ধ করতে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সততা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি প্রভাবশালী ফাঁকিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশ করেন তিনি। এ ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন জানান, সম্পদশালীদের করের আওতায় আনতে এনবিআর কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে (ই-ফাইলিং) আয়কর রিটার্ন জমা নেওয়া হবে। অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক হবে এবং করদাতারা এ ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার সুযোগ পাবে না। গত অর্থবছরের শুরু থেকে এনবিআর অনলাইনে ‘ইটিআইএন’ দেওয়া শুরু করলেও লোকবলের সংকটের কারণে এখনো পুরনো পদ্ধতিতে (কাগজে-কলমে) আয়কর রিটার্ন জমা নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে জমা দেওয়া তথ্য অধিকাংশ সময় যাচাই করা সম্ভব হয় না।
No comments:
Post a Comment