Thursday, December 18, 2014

নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ, তদারকে সেল গঠনের প্রস্তাব:প্রথম অালো

রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ের কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে কি না, তা তদারকের জন্য নির্বাচন কমিশনে ও দলে আলাদা সেল গঠন করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন-সংক্রান্ত ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমেত্যর ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি সমাজে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। প্রথম আলো আয়োজিত ‘রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বুধবার এসব
প্রস্তাব দেন রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় প্রথম আলো কার্যালয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়। গোলটেবিলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নারীরা পেশাগত দিক থেকে নিষ্ঠাবান, সৎ ও কর্মঠ। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ দেশের পোশাকশিল্প। কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীর অবস্থান আশানুরূপ নয়। মাঠপর্যায় থেকে নেতৃত্বে উঠে আসার সময় প্রথমেই নারীদের বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নারী নেতৃত্ব বাড়ানোর জন্য সব দলকে আন্তরিক হতে হবে। সারা দুনিয়ায় নারী নেতৃত্ব নিয়ে রক্ষণশীলতা আছে, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের কার্যকারিতা কম স্বীকার করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেখা যায় যে নারী বেশি সোচ্চার হতে পারেন তাঁকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদদের মধ্য থেকে ভালো পার্লামেন্টারিয়ান হয়েছেন, এমনটা কম দেখা যায়। উপজেলা পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কো-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করার প্রস্তাব দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক। তিনি বলেন, উপজেলার পুরুষ ভাইস-চেয়ারম্যানেরই কোনো ক্ষমতা নেই, নারী ভাইস-চেয়ারম্যানের তো আরও নেই। মাঠপর্যায় থেকে নারী নেতৃত্ব উঠে আসার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা আছে। দেখা যায়, মাঠপর্যায়ে নারী নেতৃত্বের জায়গাটি রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্রীরাই দখল করেন। গ্রামাঞ্চলে অন্যতম সমস্যা নারীকে পুরো ঘরের কাজ সামলানোর পর তঁাকে রাজনীতিতে যুক্ত হতে হয়। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার সুষ্ঠু উপায় বের করতে হবে। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নারী নেতৃত্বে শুধু সংখ্যা বাড়ানো নয়, তঁাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগানোর ওপর জোর দেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের পর প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এর কিছুটা অগ্রগতি হলেও মাঠপর্যায়ে তেমন অগ্রগতি নেই। ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আরও সক্রিয় উদ্যোগ দরকার। এ ছাড়া নারীকে শুধু অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না, নারীরা যেন মনে করেন তাঁরাও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ার অংশ। গোলটেবিলের শুরুতে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি চিফ অব পার্টি কেটি ক্রোক বলেন, নারী নেতৃত্ব বিকাশের জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনন্য। ওই আদেশের পর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে কোথাও কোথাও নারী নেতৃত্ব দুই শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭২ ভাগ মানুষ নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীদের দেখতে চান। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর মতে, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তিনি বলেন, এই কাঠামো ভাঙার জন্য পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীরা এগিয়ে গেলে মৌলবাদী ও জঙ্গি শক্তিগুলো যেমন পিছিয়ে যাবে, তেমনি নারী-পুরুষের মতৈক্য বাড়লে নারী নির্যাতন কমে আসবে। শুধু পুরুষের ওপর নির্ভর করে বসে না থেকে দলগুলোর ভেতরে নারীদের সংগ্রাম করার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রসঙ্গে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, এখানে শুধু রাজনৈতিক দলে নারীর নেতৃত্ব কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সংসদে, সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়ও আনা দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীরা আসতে পারবে না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান নারী-পুরুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ফলে দলগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তারপরও উপজেলা এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব বাড়ছে না। নারীরা অনেক কাজ করলেও কমিটিতে রাখা হয় না, অনেক জায়গায় পুরুষ সাংসদদের জন্য কাজ করতে পারেন না। এসব সমস্যা উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নারীর অবস্থা তদারকির জন্য দলগুলোতে আলাদা সেল গঠনের প্রস্তাব দেন সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ নূরজাহান বেগম। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তায় নারী প্রথম হলেও কেন্দ্রে পাঠানো মূল্যায়ন প্রতিবেদনে তাকে চতুর্থ দেখানো হয়। এসব বিষয় তদারকির জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সেল থাকতে হবে। জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের মহাসচিব শিরীন সুলতানা মনে করেন, পরিবারে, সমাজে বা দলের কোথাও নারীর সততা ও কর্মনিষ্ঠার মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে মিছিল-সমাবেশের আগে নারীদের খবর দেওয়া হয়, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাদের জানানোও হয় না। নিজ দল ও বিরোধী দলে পেশিশক্তি ও টাকার জোরের কাছে নারীরা পরাজিত। তিনি প্রস্তাব দেন, নেতৃত্বে নারীর অবস্থান রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও তদারক করতে হবে। সংসদে সংরক্ষিত আসনে নারীর অবস্থান ত্রুটিপূর্ণ বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি তানিয়া হক। তিনি বলেন, সংরক্ষিত আসনের নারী সাংসদদের নির্বাচনী এলাকা নেই, মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না, অঙ্গীকার পূরণের দায়বদ্ধতা থাকে না। তাঁরা নারীর ক্ষমতায়নের পরিবর্তে দলের ক্ষমতায়ন করে যাচ্ছেন। সংসদে তাঁরা নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কমই সোচ্চার হন। গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, অন্য সব বিষয়ে মতভেদ থাকলেও নারী ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা হওয়ার কোনো কারণ নেই। নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সবাইকে যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

No comments:

Post a Comment