Friday, December 5, 2014

ইয়াবায় আসক্ত ট্রেন:যুগান্তর

মারণনেশা ইয়াবাসহ নানা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে পূর্বাঞ্চলের যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো। চোরাকারবারীরা যাত্রী সেজে ইয়াবাসহ বিভিন্ন রকমের মাদকদ্রব্য নানা কৌশলে পাচার করছে রাজধানীতে। এই পথে চলাচলকারী ৫৬টি যাত্রীবাহী ট্রেনকে মাদক পাচারের প্রধান বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। অনেক নারী-শিশু এবং মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। চলতি বছর পূর্বাঞ্চলের যাত্রীবা
হী বিভিন্ন ট্রেন থেকে সাড়ে ৬ লাখ ইয়াবাসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য আটক করেছে রেলওয়ে পুলিশ। তবে পাচার হওয়া মাদকের হিসাবে এই পরিমাণ নগণ্যই। অভিযোগ রয়েছে, রেল পুলিশের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমেই নির্বিঘ্ন রাখা হয় মাদকের চালান। রেলের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যমান জনবল দিয়ে যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ দিয়ে যে হারে মাদক রাজধানীতে ঢুকছে তা রোধ করতে হলে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনে স্ক্যানিং মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে তল্লাশি নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীদের যেমন ট্রেনে তল্লাশি করা হয় না, তেমনি স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথেও কোনো নজরদারি নেই। ফলে অতি সহজে চোরাকারবারীরা যাত্রীবেশে ট্রেনে মাদক পাচার করছে। সড়কপথের বিভিন্ন স্থানে বাসসহ যানবাহনে তল্লাশি হওয়ায় রেলপথই তাদের কাছে নিরাপদ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলপথে ইয়াবাসহ মাদক পাচারে নিত্য-নতুন কৌশল অবলম্বন করছে চোরাকারবারীরা। সাধারণ ট্রেন যাত্রী তথা ট্রেনে ভ্রমণকারী বিভিন্ন মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীদের ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পাচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বিপথগামী শিক্ষার্থী নিজেরাও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে রেলপথকে বেছে নিয়েছে। অভিনব কৌশলে তারা বইয়ের মাঝখানে কেটে গর্ত করে, টুপিতে, মোবাইল সেটের ভেতর, ট্রেনের টয়লেট, বডিতে, সিটের ভেতর, ছাদে পানির ট্যাংকে রেখে ইয়াবাসহ মাদক পাচার করছে। একইভাবে তরুণীসহ নানা বয়সী মহিলারা শরীরের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি স্পর্শকাতর অঙ্গে ইয়াবা লুকিয়ে নিয়ে আসছেন রাজধানীতে। অপরদিকে নেশাজাতীয় ইনজেকশন, ফেনসিডিলসহ নানা রকমের মাদকদ্রব্য, শাড়ি কাপড়, ক্ষতিকারক বিদেশী কসমেটিকস সামগ্রীও ট্রেনে করে রাজধানীতে পৌঁছাচ্ছে চোরাকারবারীরা। সরেজমিনে ও রেলওয়ে থানা পুলিশের নথিপত্রের সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন যে পরিমাণ ইয়াবা ঢুকছে তার ৫০ শতাংশই আসছে রেলপথে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখি আন্তঃনগর, লোকাল ও মেইল ট্রেনের সংখ্যা ৫৬টি। মিয়ানমার, ভুটান ও ভারত থেকে যে পরিমাণ ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য দেশে প্রবেশ করে তার ৬০ শতাংশই এসব ট্রেনে করে রাজধানীতে নিয়ে আসা হচ্ছে। কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি থেকে সড়কপথে আসা মাদকদ্রব্য চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ড রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় স্তূপ করা হয়। তারপর যাত্রীবেশী নারী-পুরুষ ও জড়িত শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ঢাকামুখি যাত্রীবাহী ট্রেনে করে তা পাচার করা হয়। ট্রেনের গার্ড, চালক, যাত্রীরাও জানেন কারা ট্রেনে মাদক বহন করছে। তবে এ নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা দেখা যায় না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে যে ধরনের মাদকদ্রব্য বন্দর থেকে বের করা হয় তার অধিকাংশ রেলপথে রাজধানীতে আনা হয়। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত মাদক, ইয়াবা ও সিগারেট। অপরদিকে লাকসাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলাসহ সীমান্তবর্তী এলাকা হয়ে আসা যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে প্রকাশ্যে মাদক বহন করতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা সূবর্ণ এক্সপ্রেস, তুর্ণানিশিতা, মহানগর প্রভাতী, চট্টগ্রাম মেইল, ওয়ান-আপ, সিলেট থেকে ছেড়ে আসা পারাবত, জয়ন্তিকা, উপকূল, কুশিয়ারা, বাল্লা, আখাউড়া থেকে ছেড়ে আসা ডেম্যু ট্রেনগুলো সীমান্ত এলাকায় যত্রতত্র স্টেশনবিহীন দাঁড়িয়ে পড়ে। কখনো আবার ধীরগতিতে চলে। ওই সময় বস্তায় বস্তায় মাদকদ্রব্য ট্রেনে তোলা হয়। ত্রিপুরা সীমান্ত হয়ে আসা মাদকের চালান কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলা সংলগ্ন রেলপথ দিয়ে ট্রেনে তোলা হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে চট্টগ্রাম মেইল। এ ট্রেনটির কামরায় বা টয়লেটে নেই বৈদ্যুতিক বাতি। এই লোকাল ট্রেনটিকে চোরাকারবারীরা ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত করেছে। ট্রেনের অধিকাংশ কামরায় দরজা-জানালা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। টয়লেটগুলো ব্যবহৃত হয় ফেনসিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য, শাড়ি কাপড়, মসলা সামগ্রী রাখার জায়গা হিসেবে। কোনোটিতে ময়লার স্তূপে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার অবস্থা। প্রতিটি কামরার ভেতর মানুষ তিনগুণ, তার ওপর পাদানিতে, দু’বগির সংযোগস্থলে, ইঞ্জিনের বডিতে, সামনেও যাত্রীর ভিড় জমে যায়। এই ভিড়ের মধ্যেই থাকে চোরাকারবারীরা। চোখ বুলালেই নজরে পড়ে ইয়াবার পোটলা। কানে আসে ফেনসিডিলের বোতলের শব্দও। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ট্রেনটি কুমিল্লা থেকে ছাড়ার পর এক হিজড়া বসে আছে জিরার বস্তার ওপর। নিজে উঠে দাঁড়িয়ে সেখানে বসার আহ্বান জানালো সে। অন্ধকার কামরা। হঠাৎ দু’জন যুবক ধাক্কা মেরে বলে ওঠে- ‘ট্যাহা দে’। বস্তার মালিক তাদের হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আসে ১ জন আনসার ও ১ জন রেলপুলিশ সদস্য। হাতে চার্জলাইট। কামরায় থাকা চোরাকারবারীদের হাত থেকে ১০, ২০, ৫০, ১০০ টাকা করে নিয়ে পকেটে পুরে ফেলেন তারা। যেন জালে ধরা গুঁড়া মাছ খলুইতে ঢোকাচ্ছেন। এরই মধ্যে শশীদল স্টেশনের দু’পাশের আউটারে ২/৩ মিনিট করে ট্রেনটি দাঁড়ায়। সেখান থেকে ওঠে যাত্রীবেশী আরও কয়েক চোরাকারবারীরা। সঙ্গে বড় বড় ব্যাগ অথবা বস্তা। কসবা, আখাউড়া, ভাতশালা স্টেশনের আউটারেও ট্রেন দাঁড় করানো হয়। ঝাঁক বেঁধে তোলা হয় অবৈধ পণ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন ছাড়ার পর আবার ২/৩ জন যুবক, সঙ্গে জিআরপি ও নিরাপত্তাবাহিনীর ২ জন সদস্য কামরায় ঢুকে বস্তাগুলোতে গুঁতো মারতে শুরু করে। এটা কার, ওটা কার? উত্তর দ্যাস না ক্যান? কথা না কইলে বস্তা হাওয়া হয়ে যাবে- ইত্যাদি সংলাপ আওড়াতে থাকে। এর পর এক-এক করে বস্তার মালিকরা টাকা তুলে দেয় তাদের হাতে। শরীরে মাদকবহনকারী মহিলাদের সঙ্গে এ সময় রগড় করতেও দেখা যায় তোলাবাজ যুবকদের। এক সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেয় তাতে। বেশ কয়েকজন চোরাকারবারী জানায়, রেলপথে চোরাচালান করতে হলে রেল সংশ্লিষ্ট আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের টাকা দিয়েই ম্যানেজ করতে হয়। সবার চোখ ফাঁকি দেয়া গেলেও তাদের দেয়া যায় না। ট্রেনে ওঠার আগে টাকা দিতে হয়, ট্রেন চললে পরে দিতে হয় ৩/৪ দফা, টাকা দিতে হয় গন্তব্যে পৌঁছার পর। অনুযোগের সুরে তারা আরও জানালেন, এভাবে ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে না হলে লাভ আরও বেশি হতো। লাভের গুড় নাকি অনেকটাই খায় এই লাইনম্যান, জিআরপি, নিরাপত্তাবাহিনী ও আনসার বাহিনীর পিঁপড়ারা। ঢাকা রেলওয়ে জিআরপি থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ যুগান্তরকে জানান, গত ২ মাসে অন্তত ৫৬ জন চোরাকারবারীকে ইয়াবা ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্যসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। চলতি বছরে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ইয়াবা, লাখ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। তবে ইয়াবা পাচারের সময় বিভিন্ন বয়সী নারী-শিশুও গ্রেফতার করা রয়েছে। গত ৪ মাসে এ পথ দিয়ে আসা যাত্রীদের তল্লাশি করে ২৩ কেজি সোনার বারসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ইয়াবা চালান কিছুতেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে থানার অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ও সোনা বিভিন্ন ট্রেন থেকে আটক করা হচ্ছে তা মোট চোরাচালানের মাত্র ৫ শতাংশ হবে। রেলওয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম জানান, স্বল্প পুলিশ দিয়ে যাত্রী নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। রেলওয়ের ১০ ফুটের মধ্যে থেকেই তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। রেলওয়ে উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মল্লিক ফখরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, রেলওয়ে কোনো স্টেশনেই স্ক্যানিং মেশিন নেই। ফলে সন্দেহজনক যাত্রীদের তল্লাশি করা দুরূহ হয়ে যায়। তার ওপর রয়েছে লোকবল স্বল্পতা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশনসহ প্রায় সব স্টেশনে একাধিক রাস্তা থাকায় যত্রতত্র লোকজন ট্রেনে উঠছে। যাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে চোরাকারবারীরাও। এদের শনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।  

No comments:

Post a Comment