Saturday, December 20, 2014

স্কুল পেরিয়েই নেশার ফাঁদে:কালের কন্ঠ

'লেখাপড়া করতে চাইছিলাম। আব্বু চাইছে, আমি বিসিএস অফিসার হই। আমার কী থেকে কী হইল, জানি না! পড়তে আর ভালোই লাগত না। পড়ে দেখি, পড়া আর মনে থাকে না। আর পারলাম না।' কান্নাজড়ি
ত কণ্ঠে বলছিলেন মামুন হোসেন। ২৮ বছরের এই যুবক হেরোইনে আসক্ত। ইয়াবাও সেবন করেছেন কয়েকবার। সম্প্রতি রাজধানীর একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মামুন জানালেন, রাজধানীর মিরপুরের বাঙলা স্কুল থেকে ২০০৩ সালে জিপিএ ৪ পেয়ে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন তেজগাঁও কলেজে। মিরপুরে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। সেখানে গড়ে ওঠে তাঁর একটি বন্ধুমহল। কলেজজীবনে কিছুটা স্বাধীনতা পেয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচয় হয় হাজারীবাগের দুই ছেলের সঙ্গে। তাদের মাধ্যমেই একদিন হেরোইন সেবন করেন তিনি। সেই থেকে শুরু। বছরখানেক পর বাসার লোকজন তাঁর মাদকাসক্তির বিষয়টি জেনে ফেলে বলে জানান মামুন। তাঁকে ভর্তি করা হয় পুনর্বাসনকেন্দ্রে। সেখানে ছয়বার চিকিৎসা নিয়েও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি তাঁর। মাঝপথেই লেখাপড়া থেমে গেছে। মিরপুরের যুবক মামুনের মতোই অবস্থা বেশির ভাগ মাদকসেবীর। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) চিকিৎসাকেন্দ্রে যাওয়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেই অসৎসঙ্গে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণরা। শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষাজীবন। প্রায় আড়াই হাজার মাদকাসক্ত রোগীর ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী মাদকসেবীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি- ৮১.৩৭ শতাংশ। জরিপভুক্তদের ৬০.৭৮ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষা পাস। উচ্চশিক্ষিতদের তুলনায় কম শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে মাদকাসক্তির হার অনেক বেশি। ৬১.৪৭ শতাংশ মাদকসেবী প্রথম মাদক গ্রহণ করেছে বন্ধুর প্রভাবে। বেশির ভাগ মাদকাসক্ত বেকার বা কর্মহীন জীবন কাটাচ্ছে; এ হার ৫৭.৩০ শতাংশ। ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করা তরুণরা বন্ধুদের পাল্পায় পড়ে বা হতাশায় বেশি হারে মাদকাসক্ত হচ্ছে। ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে অসচেতনতা এবং অশিক্ষার কারণেও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার ঘটনা আছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এলাকায় মাদক প্রতিরোধ কমিটি করে সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে ডিএনসি। স্থানীয় জনতা ও প্রশাসনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম আরো জোরদার করা দরকার বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ডিএনসির মহাপরিচালক বজলুর রহমান বলেন, 'মাদকের কারণে তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে। আপনার, আমার, সবার সন্তানই আজ অনিরাপদ। অভিভাবকরা জানেন না তাঁর সন্তানটি বের হয়ে কার সঙ্গে মিশছে। তাই সবাইকে সচেতন হয়ে একসঙ্গে মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। কাজটি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি জেলা, উপজেলায় মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে।' তিনি বলেন, 'এরই মধ্যে ১৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে।' রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গত তিন বছরে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের (ভর্তি হওয়া রোগীরাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত) বিষয়ে ক্লায়েন্ট মনিটরিং সিস্টেমের (সিএমএস) তথ্য বিশ্লেষণ করে ডিএনসি। দুই হাজার ৩২১ জন রোগীর প্রত্যেককে এক বছরের জন্য একবার নথিভুক্ত করে তথ্য রাখা হয়। পরে সেসব তথ্য মূল্যায়ন করা হয়। সিএমএস থেকে পাওয়া তথ্য গত বছর ডিএনসির একটি প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ২০১০ সালে ৭৮৩ জন, ২০১১ সালে ৭৯৩ জন এবং ২০১২ সালে ৭৪৫ জন রোগীর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বেশির ভাগ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ডিএনসির জরিপে দেখা গেছে, তিন বছরের গড় হিসাবে মাদকসেবীদের ৬০.৭৮ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল পরীক্ষায় পাস করা। অশিক্ষিত ২৪.৭৯ শতাংশ, প্রাথমিক স্কুল পাস ১৯.৩০ শতাংশ, উচ্চ মাধ্যমিক পাস ৭.৫৮ শতাংশ ও স্নাতক পাস ৪.৭৯ শতাংশ। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে মাদকাসক্তির হার সবচেয়ে কম। সমীক্ষাধীন তিন বছরে স্নাতকোত্তর বা এর বেশি শিক্ষিত মাদকসেবী পাওয়া যায় ৩.৫২ শতাংশ। ২০-৩০ বছরের কোঠায় আসক্তি সবচেয়ে বেশি ডিএনসির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুবকরাই বেশি মাদকাসক্ত হচ্ছে। ১৫ বছর বয়স থেকে মাদকাসক্তির মাত্রা বাড়তে শুরু করে। ৪০ বছরের পর কমতে থাকে। ২০ থেকে ৪০ বছরের মাদকসেবীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি- ৮১.৩৭ শতাংশ। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মাদকসেবী ২০১০ সালে ছিল ৫৩.৩৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ৪৭.৩৫ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ছিল ৪৪.৫১ শতাংশ। ৩১ থেকে ৪০ বছরের মাদকসেবী ২০১০ সালে ছিল ২৮.৩৫ শতাংশ, ২০১১ সালে ৩২.৭০ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ছিল ৩৪.৪৯ শতাংশ। ৫৭ শতাংশ বেকার বেকারত্ব মাদকাসক্তির একটি বড় কারণ। আবার মাদকাসক্তির কারণেও কর্মহীন হয় কেউ কেউ। ডিএনসির তথ্যে দেখা গেছে, জরিপের তিন বছরে গড়ে ৫৭.৩০ শতাংশ মাদকসেবী কোনো কাজে যুক্ত ছিল না। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ১৩.২৪ শতাংশ, চাকরিজীবী ৭.২১ শতাংশ, ছাত্র ৪.৫৭ শতাংশ ও কৃষিকাজে সম্পৃক্ত ছিল .৯১ শতাংশ। বন্ধুর প্রভাবে ৬১ শতাংশ তিন বছরের গড় হিসাবে ৬১.৪৭ শতাংশ মাদকসেবী প্রথম মাদক গ্রহণ করেছে বন্ধুর প্রভাবে। এর পরই কৌতূহলবশত মাদকগ্রাহীর হার ৩২.৬৮ শতাংশ। এ ছাড়া হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হয় ৩.৬১ শতাংশ, বিরূপ পারিবারিক পরিবেশের কারণে মাদকাসক্ত হয় ২.৭৪ শতাংশ, সহজে সুখানুভূতি পেতে মাদক গ্রহণ করে ১.১৭ শতাংশ আর মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে মাদকাসক্ত হয় .৬৯ শতাংশ রোগী। রোগীদের বেশির ভাগ হেরোইনে আসক্ত দুই হাজার ৩২১ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ অপিয়ড শ্রেণির মাদকদ্রব্য যেমন- হেরোইন, মরফিন, ফেনসিডিল, পেথিডিন ও বুপ্রেনরফাইন সেবন করে। হেরোইনে আসক্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। ২০১০ সালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের ৪৭.২৬ শতাংশ, ২০১১ সালে ৫৭.৫৫ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৬৩.৮২ শতাংশ ছিল হেরোইনে আসক্ত। ২০১০ সালে ১.১৪ শতাংশ, ২০১১ সালে ৪.৪১ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৫.৭৭ শতাংশ ছিল ইয়াবাসেবী। ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছে ৪৬৪ জন রোগী। জানা গেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই একাধিক মাদকদ্রব্য সেবন করত। অপিয়ড জাতীয় মাদক সেবন করত ৮৯.২২ শতাংশ রোগী। ৬.৮৯ শতাংশ ইয়াবাসেবী অন্য জাতের মাদকও গ্রহণ করত। ২৭.৫৮ শতাংশ গাঁজাসেবীও অন্য ধরনের মাদক গ্রহণ করত। সচেতনতামূলক কর্মসূচি সূত্র জানায়, ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস উদ্‌যাপনের পাশাপাশি সারা বছর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালায় ডিএনসি। পোস্টার, স্টিকার, লিফলেটসহ বিভিন্ন প্রচারপত্র বিলি করা হয়। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ২০০ পোস্টার এবং প্রায় দেড় লাখ লিফলেট ও স্টিকার বিলি করা হয়েছে। এ সময়ে প্রায় ২৫ হাজার সভা ও সেমিনার করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৪৩৭টি শ্রেণিতে সচেতনতামূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরে ছয় হাজার প্রকাশনা এবং প্রতি মাসে দেড় হাজার বুলেটিন প্রচার করে সচেতনতার নানা তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মাদকবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার ৫৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডিএনসির চিকিৎসা ও পুনর্বাসন বিভাগের পরিচালক মো. মজিবুর রহমান অধিদপ্তরের নিরোধ-শিক্ষা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়েছেন সম্প্রতি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ৬৪ জেলায় সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সচেতনতামূলক নাটক ও গানের সিডি জেলা তথ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। প্রাইভেট সেক্টর ও এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।'      

No comments:

Post a Comment