অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দাঁড় করিয়েছে নিজের এযাবৎ লালিত আদর্শের মুখোমুখি। কীভাবে তিনি এর মোকাবিলা করবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। একদিকে রয়েছে মোদির উন্নয়নের অঙ্গীকার, যার অংশ হিসেবে উঠে এসেছে তাঁর সরকারের বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প, অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রচেষ্টা এবং নিজেকে বিশ্বপর্যায়ের নেতাদের সারিতে উন্নীত করা। অন্যদিকে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তাঁরই এয
াবৎ আদর্শগত সিদ্ধান্ত। হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠা এবং ভারতকে দীর্ঘ ৮০০ বছর পর আবার ‘প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করার যে স্বপ্ন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) আজন্ম দেখে আসছে, যে স্বপ্নের শরিক নরেন্দ্র মোদি নিজেই, তা তাঁকে দাঁড় করিয়েছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে। এতটাই যে, মোদির অসন্তোষ ও ক্ষোভও সংঘ পরিবারদের শরিকদের দমাতে ব্যর্থ। তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাটে ২০০ খ্রিষ্টানকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে এনে তাঁরই পরিবারের সদস্যরা তাদেরই প্রধানমন্ত্রীকে পরিহাস করেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় আলোচনার কেন্দ্রে আসা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিংঘল স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ৮০০ বছর পর ভারত আবার অকৃত্রিম হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। সিংঘলের ইতিহাসজ্ঞান অনুযায়ী, ত্রয়োদশ শতকে রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের পর থেকেই নাকি ভারতের হিন্দুত্বে কালি লেপা শুরু। হিন্দুত্বের অবমাননার সেই যে সূত্রপাত, তিনি মনে করেন, সেই গ্লানি ঘোচানোর প্রকৃত সময় এসেছে এবার। কারণ, তাঁর কথায়, ‘এই প্রথম আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠিত। সেই সরকার যা হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় সমর্পিতপ্রাণ। আমাদের মূল্যবোধ ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।’ শুধু অশোক সিংঘলই নন, সুগ্রীব দোসরের মতো আসরে নেমেছেন খোদ সংঘপ্রধান মোহন ভগবত। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে তিনি শুধু তাঁদের প্রধানমন্ত্রীকেই নন, দেশের সংবিধানকেও ফেলে দিয়েছেন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। মোহন ভগবতের কথায়, ‘এটা আমাদের দেশ। আমাদের হিন্দু রাষ্ট্র। অতীতে যা আমরা হারিয়েছি, যে গরিমা, তা আমরা ফেরত আনার চেষ্টা করব। এই হিন্দু জাগরণে কারও ভয় পাওয়ার কারণ নেই। হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে যারা গলা তুলছে, তারা স্বার্থপর। যদি তারা বিরোধিতা করে তাহলে সংঘাত অনিবার্য।’ এখানেই শেষ নয়। যে নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে উন্নয়নের ফসল ছড়িয়ে দিতে চাইছেন, সেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উল্লেখ করে মোহন ভাগবত বলেছেন, ‘ওই দুই রাষ্ট্রের অপরাধ আমরা সহ্য করে চলেছি। আমাদের ঈশ্বর বলেন, ১০০ অপরাধ করার পর আর কোনো অপরাধকে ক্ষমা করতে নেই।’ কী করবেন নরেন্দ্র মোদি? এ প্রশ্নই এ মুহূর্তে মোক্ষম হয়ে উঠেছে। আগ্রায় ২০০ মুসলমানকে ধর্মান্তর করার পর থেকে ভারতীয় সংসদ সেই যে অচল হয়ে রয়েছে, আজও তা সচল হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে উত্তাল দুই কক্ষের বিরোধীরা। মোদি না পারছেন প্রকাশ্যে নিজের আদর্শকে রক্ষা করতে, না পারছেন তাঁকে সমালোচনার কাঠগড়ায় তুলতে। হিন্দুত্ববাদের কথা বললে সুশাসন শিকেয় উঠবে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেশকে দাঁড় করাবে এক ভয়ংকর বিপদের মুখে। ভেস্তে যাবে তাঁর যাবতীয় উন্নয়নের কর্মসূচি। আবার হিন্দুত্ববাদের নিন্দায় সরব হলে সরাসরি নিজেকে দাঁড় করাবেন এযাবৎ লালিত আদর্শের সঙ্গে সংঘাতের আঙিনায়। এই অদ্ভুত দোলাচল তাঁকে বধির করে রেখেছে। ধর্মান্তর নিয়ে তাঁর সরকারের নীতি সম্বন্ধে একটি শব্দও তাই এখন পর্যন্ত তাঁর মুখ থেকে বেরোলো না। তিনি নিজেই তাঁর আদর্শ ও অঙ্গীকারের জাঁতাকলে আটকা পড়েছেন। আর সেই সুযোগে দিব্যি আসর মাতাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। দিকে দিকে গৃহীত হচ্ছে ‘ঘর ওয়াপসি’ বা একদা ধর্মান্তরিতদের ঘরে ফেরানোর কর্মসূচি। সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার ধর্মান্তরবিরোধী আইন আনতে আগ্রহী। সেই আইন জবরদস্তি ধর্মান্তরকে নিষিদ্ধ করবে। ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে সংঘাতের ক্ষেত্র। কীভাবে মোকাবিলা করবেন নরেন্দ্র মোদি? তাঁর সরকারের সুশাসন, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের রাস্তায় কাঁটা বিছাতে প্রস্তুত তাঁরই আদর্শগত হিন্দুত্ববাদের নতুন জাগরণ। কী হবে তাঁর রণনীতি? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো মুখে রা কাড়েননি।
No comments:
Post a Comment