১৯ নভেম্বর রাত নয়টা ৫১ মিনিট। ঢাকা শিশু হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন বগুড়ার শেরপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ইব্রাহিম খলিল। তিনি বললেন, দুপুরে নার্সরা বলেছিলেন, তাঁর ৪০ দিন বয়সী মেয়েকে বাঁচাতে হলে ক্লিনিকের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নিতেই হবে। কিন্তু বিকেল নাগাদ চিকিৎসক এসে বললেন, মেয়ে সুস্থ। তাঁর কাছে মেয়ের অবস্থার এই হঠাৎ উন্নতি আশ্চর্যজনক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাস
পাতালের কমপক্ষে তিনজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ার্ড থেকে রোগীর স্বজনদের এমন পরামর্শ প্রায়ই দেওয়া হয়। ভয় দেখিয়ে ও ভালো চিকিৎসার কথা বলে হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে ক্লিনিকে নেওয়া হয়। হাসপাতালের কোনো কোনো আয়া, নার্স ও নিরাপত্তারক্ষী এই কাজ করেন। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে ১৯ ও ২০ নভেম্বর রাতে প্রতিবেদকদ্বয় কয়েক ঘণ্টা শেরেবাংলা নগরে শিশু হাসপাতালে অবস্থান করেন। সে সময় রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। চিকিৎসকদেরও রোগীদের সেবায় ব্যস্ত দেখা যায়। তবে বিছানা খালি না থাকলে রোগীকে পাশেই সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। ২০ নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা থেকে গুরুতর অসুস্থ এক শিশুকে নিয়ে তার পরিবার আসে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। বিছানা খালি না থাকায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। শিশুটিকে নিয়ে অভিভাবকেরা জরুরি বিভাগ থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন নিরাপত্তারক্ষী ছুটতে থাকেন ওই শিশুর মায়ের পিছু পিছু। ওই নিরাপত্তারক্ষীই আগের রাতে গলা ধাক্কা দিয়ে ফটকের বাইরে বের করে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে। রাত ১০টার পর রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি থাকতে পারবেন না—এ নিয়ম জানা না থাকায় তিনিও গুরুতর অসুস্থ নাতির বাবা-মায়ের সঙ্গে ওয়ার্ডে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। নিয়মের ব্যাপারে এমন কড়া (!) নিরাপত্তারক্ষীর পরদিন আরেক অভিভাবকের পেছনে ছোটার রহস্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল চমকপ্রদ তথ্য। জানা গেল, নিরাপত্তারক্ষীরাও রোগী ভাগিয়ে ক্লিনিকে পাঠান। রোগী পাঠাতে তাঁদের প্রথম পছন্দ পেডিহোপ হাসপাতাল নামের ক্লিনিক। নিরাপত্তারক্ষী, আয়া, নার্সদের কেউ কেউ আরও দুটি ক্লিনিকে যাওয়ারও পরামর্শ দেন। মূল ফটকের দায়িত্বে ২০ নভেম্বর রাতে ছিলেন দুই নিরাপত্তারক্ষী। পরিচয় গোপন রেখে প্রতিবেদকদ্বয় এক আত্মীয়র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সন্তানকে চিকিৎসার জন্য কোথায় নেওয়া যায়—জানতে চাইলে ওই নিরাপত্তারক্ষীরা পেডিহোপ ক্লিনিকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সঙ্গে দেন ‘বাবু’ নামের এক ব্যক্তির মুঠোফোন নম্বর। কথাবার্তার ফাঁকে প্রতিবেদকেরা নিজেদের পরিচয় দেন। ওই ক্লিনিকে রোগী পাঠালে লাভ হয় কি না, জানতে চাইলে একজন বলেন, ‘আপনার বাড়ির কাজের মানুষ নিজের দায়িত্বের বাইরে দুটো কাজ করলে বকশিশ দেন না? ওই রকম আরকি।’ নিরাপত্তারক্ষীর দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ২২ নভেম্বর ফোন করলে বাবু নামের এক ব্যক্তি বলেন, তাঁদের ক্লিনিকের (পেডিহোপ) নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র সবচেয়ে ভালো। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের খরচ দিনে সাত হাজার টাকা, বড় স্যারের ফি এক হাজার টাকা। বড় স্যার কে জানতে চাইলে বাবু বলেন, শিশু হাসপাতালের পরিচালক মনজুর হোসেন। বাবুর সঙ্গে কথা শেষ হতে না-হতে বেলা পৌনে দুইটায় মনজুর হোসেনকে পেডিহোপ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। ঢাকা শিশু হাসপাতালে সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব পালনের কথা। পেডিহোপে ২২ নভেম্বর কথা হয় এক রোগীর বাবার সঙ্গে। পেশায় কৃষক মো. কবির নামের ওই ব্যক্তি বলেন, চাঁদপুর থেকে এসে ছেলেকে নিয়ে সাত দিন ধরে এখানে আছেন। ছেলের মলদ্বারে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। শিশু হাসপাতালে গিয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালের লোকজন তাঁদের বলেছেন, শিশু হাসপাতাল আর পেডিহোপে অস্ত্রোপচারের খরচ একই। তবে পেডিহোপে ব্যবস্থা ভালো। ঢাকা মেডিকেলে নিয়মিত এ ধরনের অস্ত্রোপচার হয় নামমাত্র খরচে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিশু হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের খরচ কিছুটা বেশি হওয়ায় অনেক শিশুকেই চিকিৎসকেরা ঢাকা মেডিকেলে পাঠান। পেডিহোপে কথা হয় আগের রাতে অসুস্থ নাতনিকে নিয়ে নোয়াখালী থেকে আসা এক বৃদ্ধার সঙ্গে। অনবরত কাঁদতে থাকা ওই নারী এ প্রতিবেদককে বলেন, এখানে আসার আগে তাঁরা শিশু হাসপাতালে ফোন করেছিলেন। সেখান থেকে বলা হয়েছে, বিছানা খালি নেই, পেডিহোপে যেতে পারেন। পরে এখানে এসেছেন। তিনি জানালেন, টাকা জোগাড় না হওয়ায় তাঁরা ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছেন। রোগী ভাগিয়ে আনার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিশু হাসপাতালের পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, তিনি পেডিহোপের সঙ্গে যুক্ত আছেন। শিশু হাসপাতাল থেকে রোগী পেডিহোপে আসেন ঠিকই, তবে রোগী ভাগিয়ে আনার অভিযোগ সত্য নয়। শিশু হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী, আয়া ও নার্সদের রোগীদের পেডিহোপে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে শিশু হাসপাতালের কেউ তাঁকে কখনো কিছু জানায়নি। অফিস সময়ে পেডিহোপে যাওয়া প্রসঙ্গে মনজুর হোসেন বলেন, মাঝে মাঝে কাজ পড়লে হাসপাতাল ছেড়ে এদিকে (পেডিহোপ) আসেন। যানজট ঠেলে পরে আর হাসপাতালে যান না। তিনি বলেন, ‘অফিস চলার সময় তো মিটিংয়েও যেতে হয়, তখনো আর ফিরতে পারি না।’
No comments:
Post a Comment