Friday, January 2, 2015

এই দুর্ঘটনা একটি সতর্কবার্তা:প্রথম অালো

সুন্দরবনে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা আমাদের বড় ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বনের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।  কথাগুলো বলেছেন সুন্দরবনে তেলের ট্যাংকারডুবির ক্ষতি নিরূপণ করতে গঠিত জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ সরকারের সমন্বিত বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই দলটির কয়েকজন সদস্য এসেছিলেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে। বিশেষজ্ঞ দলটি গত বুধবার তাদের প্রাথমিক পর
্যবেক্ষণ ও সুপারিশ গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরে। গতকালের আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা সেসব পর্যবেক্ষণ আবার তুলে ধরে জানান, প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় এবার বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে সুন্দরবন। তবে দীর্ঘ মেয়াদে কী হবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধ করার সুপারিশও পুনর্ব্যক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা। ২৫ সদস্যের দলটিতে ছিলেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের আট দেশের বিশেষজ্ঞ। সুন্দরবনে তাঁরা ছিলেন টানা পাঁচ দিন। দলটির প্রধান এমিলিয়া ওয়ালস্ট্রম বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যমের প্রশংসা করে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যে বনের ক্ষতি প্রাথমিকভাবে নিরূপণ করা এবং সুন্দরবন নিয়ে উন্নততর কাজ করার সক্ষমতা তাঁদের আছে। সুন্দরবনে এবার যে ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, এককথায় তার ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায় না, আলোচনায় অংশ নিয়ে এমন মত দেন জাতিসংঘের দুর্যোগ নিরূপণ ও সমন্বয় সংস্থার পার অ্যান্ডারস বার্টলিন। তিনি জানান, ক্ষতি নিরূপণে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। এ জন্য দীর্ঘ সময় দরকার। বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম জানান, বিশেষজ্ঞ দল যে সুপারিশ করেছে সরকারের উচিত সেটিকে সম্মান জানানো। এই বিশেষজ্ঞ দল গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বদরুল ইমাম বলেন, ‘সুন্দরবনে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পর গণমাধ্যমের একটি অংশ সব শেষ হয়ে গেল করে রব তুলল। আবার অনেকের কথায় এমন ধরন ছিল যেন কিচ্ছু হয়নি। এই দল একটি নৈর্ব্যত্তিক অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করে বলেছে, ক্ষতি হয়েছে তবে তা ভয়াবহ নয়। আমরা সৌভাগ্যবান, প্রকৃতি আমাদের পক্ষে ছিল। বনের ভেতরে তেল প্রবেশ করতে পারেনি।’ তবে দীর্ঘ মেয়াদে বনের ক্ষতি নিরূপণে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দেন তিনি। শ্যালা নদীর সাম্প্রতিক তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা, জানান বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান। তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা বিভিন্ন তথ্যচিত্রে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দেখেছি।’ দুবাই সিটি করপোরেশনের বন্য প্রাণী উপদেষ্টা রেজা খান বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তে ভুল ছিল। পশুর ছাড়া সুন্দরবনের আর কোনো নদীতে নৌ চলাচল বন্ধ করতে হবে। ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। আলোচনায় অংশ নিয়ে জতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপির) সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর খুরশিদ আলম বলেন, যেকোনো দুর্যোগ কিছু সুযোগ নিয়ে আসে। এবার দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনে যে পর্যবেক্ষণ করলেন, তা বৈশ্বিক জ্ঞানের একটি অংশ হয়ে গেল। সুন্দরবন রক্ষায় যে একটি বৈশ্বিক ঐক্য আছে এবারের প্রচেষ্টা তারই উদাহরণ। এবার সুন্দরবনে যে ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়োজিত করা খুবই দরকার বলে মন্তব্য করেন পানিতে তেলনিঃসরণ বিশেষজ্ঞ লোয়িক কেরোমব্রাঁ। শ্যালায় দুর্ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তার প্রশংসা করেন কেরোমব্রাঁ। আলোচনায় সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক মমিনুল হক সরকার জানান, পোল্ডার নির্মাণ ও চিংড়িঘেরের কারণে উপকূলীয় অনেক নদীর বুক পলিতে ভরে গেছে। মংলা-ঘসিয়াখালি রুটে যে মাত্রায় পলি জমে কেবল খনন করে তার নাব্যতা ফিরিয়ে আনা যাবে না। এখন যে বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞ দল তুলে ধরেছে সেটি চূড়ান্ত কিছু নয়, জানান ইউএনডিপির পরিবেশ ও জ্বালানিবিষয়ক কর্মসূচি বিশ্লেষক আলমগীর হোসেন। তিনি জানান, সুন্দরবনের নানা ধরনের নমুনা বিদেশে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ফল আসার পর ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেদন তুলে ধরা হবে। ক্ষতির যে মাত্রা সেটি ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। এটি চালিয়ে যেতে হবে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘২০১১ সালে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল শুরুর সরকারি সিদ্ধান্তের পরই এর বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে। আমরা মনে করি, অত্যন্ত ক্ষতিকর সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল এটি। তবে সরকারের মধ্যেও এর বিরোধিতা ছিল। নৌ চলাচল নিয়ে দুটি পক্ষ দাঁড় হয়ে গিয়েছিল সরকারের মধ্যেই।’ আলোচনায় আরও অংশ নেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য স্তিফান লো ফ্লশ, হারুকা ইজাকি ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

No comments:

Post a Comment