আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে তার মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়ে শনিবার রাতে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে থেকে ফিরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছেলের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান খালেদা জিয়াকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী আসার ১০ মিনিট আগে খালেদা জিয়ার অসুস্থ থাকার বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাড
ভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস যোগাযোগ করলে আমি তাকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি জানিয়েছিলাম।’ কিন্তু শিমুল বিশ্বাসের বক্তব্যের মাত্র ১০ মিনিট পর ৮টা ৩৩ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের মূল ফটকের সামনে পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর। কিন্তু ওই প্রেস ব্রিফিংয়ের ১০ মিনিট পরই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের মূল ফটকের সামনে পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। গাড়ি থেকে নেমে প্রধানমন্ত্রী সেখানে ২ মিনিট অবস্থান করেন। এরপর তিনি গাড়ির ভেতরে ৬ মিনিট বসেছিলেন। কিন্তু কার্যালয়ের মূল ফটক ভেতর থেকে তালা দেয়া থাকায় তিনি প্রবেশ করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর আসার খবর পেয়ে কার্যালয়ের ভেতর থেকে ছুটে আসেন অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তখন তিনি মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান পাপন এমপি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান সিকদার প্রমুখ। সরেজমিন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর আসার আগেই বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ভেতর ও বাইরে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী হাজির হন। রাত ৮টা ২৫ মিনিটের দিকে কার্যালয়ের গেটের ভেতরের দিক থেকে তালা দেয়া হয়। রাত ৮টা ২০ মিনিটে গণভবন থেকে শেখ হাসিনা গুলশানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার খবর নিশ্চিত হন সাংবাদিকরা। ৮টা ৩৩ মিনিটে শেখ হাসিনার গাড়িবহর গুলশান কার্যালয়ের সামনে পৌঁছায়। সেখানে প্রায় ৮ মিনিট অবস্থানের পর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর গুলশান কার্যালয় ত্যাগ করে। ৮টা ৪০ মিনিটে গুলশান কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী একজন মা হিসেবে সমবেদনা জানাতে আসেন। এর মধ্যে তার রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তিনি সমবেদনা জানাতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে যোগাযোগ করে আমরা এসেছি। যদি যোগাযোগ নাও করে এসে থাকেন তারপরও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন এসেছেন সেখানে দরজা বন্ধ করে দেয়া কোনো ভদ্রোচিত কাজ নয়।’ ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরও বলেন, দুঃসময়ে ঘটা করে কিছু বলা যায় না। দুঃসময়ে সময় করে আসা যায় না। প্রধানমন্ত্রী দুঃসময়ে ঘটা করে আসেননি। তিনি ঘটনা শুনেছেন। শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজে এসেছেন। কাউকে পাঠাননি। তিনি সব প্রটোকল, নিরাপত্তা বেঁধ করে একজন মায়ের মতো, একজন রাজনীতিবিদের মতো এখানে এসেছেন। কিন্তু যে শিষ্টাচার অপরপক্ষ দেখিয়েছে আমি তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করি। এর মাধ্যমে তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করেনি, মায়ের যে আকুতি, রাজনীতিবিদদের যে শিষ্টাচার, তাকেই অপমান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে ছুটে এসেছিলেন এটাই শিষ্টাচার ও মানবিকতা। কিন্তু যে আচরণটি তিনি পেলেন, তা কারোর জন্যই ইতিবাচক নয়। এর কিছুক্ষণ পর পাল্টা প্রেস ব্রিফিং করেন অ্যাডভোকেট শিমুল বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর আসার খবরে আমি দৌড়ে এসেছিলাম প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে। কিন্তু আপনারা দেখেছেন তিনি ফিরে গেছেন। শিমুল বিশ্বাস বলেন, বিষয়টি ভিন্ন খাতে নেয়া বা এটি নিয়ে নোংরা রাজনীতি করবেন না। আমি তাদের আগেই বলেছি খালেদা জিয়া ঘুম থেকে উঠলেই তাদের জানানো হবে। এবং একটি সময় নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু নোংরা কথা বলে আজকের এই শোককে তাচ্ছিল্য করবেন না। শোক বইটি নিয়েই আমি নিচে নেমেছিলাম। তার আগেই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) চলে গেছেন। যারা বলছেন প্রধানমন্ত্রী আসার পরও আমরা গেটে তালা দিয়ে রেখেছি তা ঠিক নয়। তিনি এখনও (৯টা ২৫) ঘুমিয়ে আছেন। যদি দেখা করতে হয় প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেই সময় নির্ধারণ করা হবে। এদিকে রাতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান, তখন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কেউ আসেনি। গেট তালা বন্ধ ছিল। তার আগেও গেট খোলা ছিল। এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস যা বলেছেন তা সত্য নয়। মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। তিনি একবারের জন্যও গেটের বাইরে আসেননি। তখন তার হাতে কোনো বইও ছিল না। এসব নিয়ে যা ঘটল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকল। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল সাংবাদিকদের বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার জ্ঞান ফেরার পর প্রধানমন্ত্রীর আগমনের খবর তাকে জানানো হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা করেন খালেদা জিয়া সুস্থ হলে প্রধানমন্ত্রী আবার আসবেন। সোহেল আরও বলেন, এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর ড. ওয়াজেদ মিয়ার ইন্তেকালের পর তখন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেটাও ছিল ব্যক্তিগত বিষয়। উল্লেখ্য, ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর ধানমণ্ডির সুধাসদনে যান খালেদা জিয়া। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী যাবেন- এই খবরে আগে থেকেই কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। সন্ধ্যার আগে থেকেই সেখানে ভিড় জমান সংবাদকর্মীরা। সন্ধ্যা ৭টা থেকে এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের চারপাশে অবস্থান নেন। সামনের সড়কের দুই দিকে ব্যরিকেড দিয়ে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গুলশান কার্যালয়ের সামনে পৌঁছায় এসএসএফ সদস্যরা। তারা আশপাশের লোকজন সরিয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেন। রাত ৮টার মধ্যে সিএসএফের (চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স) সঙ্গে আলোচনা করে এসএসএফ সদস্যরা গুলশান কার্যালয় এলাকার নিরাপত্তা দায়িত্ব নেয়। সেখানে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), মহিলা পুলিশ ও র্যাব সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়। তারা পুরো এলাকা কর্ডন করে রাখে। চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের গেটের বাইরে অবস্থান নেয় এসএসএফ সদস্যরা। সংবাদকর্মীদেরও নির্দিষ্ট দূরত্বে সরিয়ে দেয়া হয়। শিমুল বিশ্বাসের প্রথম দফা ব্রিফিংয়ের পর ধারণা করা হয় প্রধানমন্ত্রী আসছেন না। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই চলে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৩ জানুয়ারি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান ফটক তালাবদ্ধ ছিল। গতকাল গিয়ে ওই ফটকে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। পকেট গেটও তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। দলের সিনিয়র নেতা, অন্যান্য দলের নেতা ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রবেশের জন্য মাঝে মধ্যে পকেট গেটটি খোলা হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী আসার আগে ওই পকেট গেটে তালা দিয়ে বিএনপি কার্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মী ও নেতারা সরে যান। ওই সময়ে ভেতরে থাকা নেতাকর্মীরাও আটকা পড়েন। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার অন্তত ২০ মিনিট পর ওই গেট খোলা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে প্রবেশ করতে না দেয়ায় ভেতরে থাকা নেতাকর্মীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কেউ কেউ বলেন, ‘তার কারণেই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু হয়েছে।’ মাকে (খালেদা জিয়া) যে কোনো সময়ে গ্রেফতার করা হতে পারে কোকো এমন আতংকে ছিলেন বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার লুৎফুল কবির যুগান্তরকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরও গুলশান কার্যালয় এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো।
No comments:
Post a Comment