দেশের মোট ৬৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ১৬৭ জন। তার বিপরীতে বর্তমানে কারাগারগুলোতে বন্দি আছে ৬৯ হাজার ৪০০। কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বা কয়েদি ১৯ হাজার ৮০০। বাকি সব বিচারাধীন বন্দি বা হাজতি। প্রতিদিন হাজতির সংখ্যা বাড়ছে। ফলে অতিরিক্ত ৩৫ হাজার ২৩৩ বন্দির সংস্থান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। একজনের স্থলে থাকতে হচ্ছে তিনজনকে। সবচেয়ে বেশি বন্দির চাপ সামলাতে হচ্ছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্ত
ৃপক্ষকে। এখানে ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি আছে ৪ হাজার ৮৩২ বন্দি। বিপুলসংখ্যক বন্দির কারণে কারাগারগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও আনুসঙ্গিক সুবিধা পাচ্ছে না বন্দিরা। টয়লেটে যেতে হয় লম্বা লাইন দিয়ে। খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বন্দিরা। এত বেশিসংখ্যক বন্দির সংস্থানে কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘আগে থেকেই ধারণক্ষমতার দিগুণ বন্দি ছিল। তখনও বন্দিদের থাকা-খাওয়া ও আনুসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এখন বন্দি ধারণক্ষমতার দিগুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ হয়েছে। ফলে একজনের জায়গায় দুই বা তিনজন করে থাকতে হচ্ছে। এতে সমস্যা তো কিছু হবেই। বন্দির সংখ্যা যত বেশিই হোক সাধ্যের মধ্যে আমরা বন্দিদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে যাচ্ছি।’ দেশের সর্বাধিক বন্দি আছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এই কারাগারের ধারণক্ষমতা মাত্র ২ হাজার ৬৮৬ জন। তার বিপরীতে শনিবার সকালে বন্দির সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৫১৮। সন্ধ্যায় এসেছে (আমদানি) আরও প্রায় ৫০০ বন্দি। প্রতি সপ্তাহে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আসামি ‘চালান’ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কারাকর্তৃপক্ষ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী যুগান্তরকে জানান, ‘ধারণক্ষমতার অনেক বেশি বন্দি হলেও সংস্থানে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। এই কারাগারে এক সময় ১২ হাজার বন্দি থাকার রেকর্ডও আছে। বন্দির সংখ্যা নির্দিষ্ট একটি মাত্রায় রাখাতে সপ্তাহে দুইদিন বন্দিদের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ ও পার্ট-২ এ পাঠানো হয়। অপর এক কর্মকর্তা জানান, শুক্র ও শনিবার কাশিমপুরে প্রায় এক হাজার বন্দি পাঠানো হয়েছে। থানা পুলিশের নিয়মিত গ্রেফতার ও অভিযানের পাশাপাশি চলছে যৌথ অভিযান, ব্লক রেইড এবং চিরুনি অভিযান। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে বিপুলসংখ্যক আসামি গ্রেফতার হচ্ছে। আদালতের মাধ্যমে তাদের পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, তিন সপ্তাহ ধরে কারাগারে যেসব আসামি আসছে তার ৮০ শতাংশ রাজনৈতিক মামলার আসামি। এসব মামলায় জামিন পাচ্ছে খুবই কমসংখ্যক আসামি। কারাগারের সেলগুলোতে ১০ জনের থাকার ঘরে থাকতে হচ্ছে ৩০ জনকে। কারাগারে খাবার সরবরাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা জানান, আসামির সংখ্যা দিগুণ বা তিনগুণ হলেও বন্দিদের খাবারের বরাদ্দ সেভাবে বাড়ানো হয়নি। ফলে মাছের স্থলে সবজি, শিমের জায়গায় আলু দেয়া হচ্ছে বন্দিদের। রুটি, সবজি, ডালও সরবরাহ হচ্ছে চাহিদার তুলনায় কম। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি মাহবুবের সঙ্গে দেখা করতে যান তার ভাই মাসুম। তিনি জানান, তার ভাইকে একটি রাজনৈতিক মামলায় দুই সপ্তাহ আগে গোড়ান এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার দুপুর দুইটায় ২০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছেন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি জানান, তার ভাইয়ের জন্য মাসে ছয় হাজার টাকা দিয়ে সিট নিয়েছেন। কারাগারের দেয়া খাবার খেতে না পারায় নিজেরা কয়েকজন মিলে রান্না করে খান। এ জন্য সপ্তাহে আরও ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মনিহার সেলে ছিলেন বংশালের বিপ্লব। তিনি বৃহস্পতিবার জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। যুগান্তরকে জানান, কারাগারে ইলিশ ফাইল করে ঘুমাতে হয়। টয়লেটে যাওয়ার জন্য সকালের দিকে এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। গোসলের সুযোগ দেয়া হয় সকালে একবার। হাজার হাজার বন্দিকে এক সঙ্গে গোসল করতে হয়। টয়লেটে যাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেই গোসলের সময় শেষ। ৩০০ বন্দির ধারণক্ষমতার এই সেলে বন্দি আছে এক হাজারের বেশি। সকালে লাল আটার পুড়ে যাওয়া রুটি, বিকালে পাতলা ডাল আর সবজি দেয় যা খেয়ে একজন মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা খুবই কষ্টকর। কারা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বন্দির বেশি চাপ পড়ছে ঢাকা, কাশিমপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম কারাগারে। রাজনৈতিভাবে তুলনামূলক স্থিতিশীল জেলার কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা ধারণক্ষমতার মধ্যেই আছে। নেত্রকোনা কারাগারের জেলার আমজাদ হোসেন ডন যুগান্তরকে জানান, নেত্রকোনা জেলা কারাগারে অতিরিক্ত বন্দির চাপ নেই। ফলে বন্দিরা ভালো আছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনে চিকিৎসা নিচ্ছেন আলী হোসেন নামে এক বন্দি। তিনি জানান, কারাগারের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে এই হাসপাতালে এসেছেন। এজন্য প্রতিদিন বাড়তি টাকা দিতে হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের এআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, কারা অধিদফতরে মোট ১১০ জন চিকিৎসক থাকার কথা। সেখানে চিকিৎসক আছেন মাত্র ১০ জন। এছাড়া কারাবন্দিদের মধ্যে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মাদকাসক্ত বন্দি আছে। তাদের অধিকাংশকেই কারাগারে প্রবেশের দিনই হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে। ফলে বিপুলসংখ্যক বন্দিকে সুচিকিৎসা দেয়া কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব হয় না।
No comments:
Post a Comment