Tuesday, January 13, 2015

চঞ্চল পাখি বন খঞ্জন:প্রথম অালো

যে সরু মেঠোপথ ধরে শীতের সকালে হেঁটে চলেছি একাকী—সে পথটির দুই পাশ জোড়া হলুদ সরষেখেত। মিষ্টি ঝাঁজালো গন্ধে মন-প্রাণ ভরে যাচ্ছে। ভোরের সূর্য উঠেছে। সূর্যের আলোয় সরষে ফুলগুলোতে যেন হাজার হাজার মুক্তকণা দুলছে—শিশিরবিন্দু ওগুলো। পথের দুই পাশে সারি সারি খেজুরগাছ। রসের ঠিলাগুলো খুব ভোরেই নামিয়ে নিয়ে গেছে গাছিরা। সামনের দিক থেকে একটি পাখিকে পথটা ধরে পিলপিল পায়ে ছন্দময় দৌড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে
দেখলাম। আসলে দৌড়াচ্ছে না, হাঁটছে। হাঁটাটাই ওদের দৌড়। সরলরেখা ধরে ও আসছে না, ডান-বাঁ করতে করতে এগোচ্ছে, খুঁজছে পোকামাকড়—যা ওর খাবার। যত দ্রুত বেগে ও হাঁটছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ দ্রুত ও ওর লেজটা দোলাচ্ছে—দোলাচ্ছে ওপরে-নিচে, ডানে-বাঁয়ে—লেজের পালকগুলো মেলে দিয়ে বক্রাকারে ওপরের দিকে যেমন তুলছে, তেমনি নামাচ্ছে নিচের দিকেও। মুখোমুখি হতেই বিরক্ত হলো খুব, তাকাল আমার দিকে থমকে দাঁড়িয়ে—সন্দেহ ওর কুতকুতে চোখে, কিছুটা ভয়ও। তবু একটি পোকা দেখে খাড়া লাফে উঠে চমৎকার একটা পাক খেল—শূন্যে পোকা মুখে বসল আবার আগের জায়গায়। স্থির আমি। দেখা যাক আরও কাছে আসে কি না পাখিটা! না, উড়াল দিল; যেদিক দিয়ে ও আসছিল—সেই পথ সমান্তরালে ছন্দে ছন্দে দুলতে দুলতে উড়ে গিয়ে বসল বেশ দূরের একটা খেজুরগাছের রসের নলিতে। নলি বেয়ে নামা রস পান করছে যখন, তখন ঘুড়ি ওড়ানো সুতোর ফাঁসফাঁদ পেতে রাখা বালকটি সুতো ধরে দিল হ্যাঁচকা টান। ব্যস! ফাঁসে পা আটকে পাখিটি ওড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে সরষেখেতের ভেতর পড়ল। কাছে গিয়ে দেখি, বালকটির খালুইতে একটি কাঠশালিক ও দুটি বুলবুলি পাখির সঙ্গে রাখা হয়েছে এইমাত্র ধরা পাখিটিও—বালক রোজই এভাবে পাখি ধরে। পাখিটিকে খাঁচার ভেতর থেকে বের করলাম, ভালো করে দেখলাম এবং আচমকা ছেড়ে দিলাম—একটি মাত্র ডাক দিয়ে পাখিটি ছিটকে শূন্যে উঠেই দ্রুত উড়ে সরষে ভরা মাঠ পাড়ি দিয়ে চলে গেল দূরের গ্রামীণ বনটির দিকে। পেলব শরীরের ও মায়াবী চোখের নিরীহ এই পাখির নাম বন খঞ্জন। ইংরেজি নাম Forest Wagtail। বৈজ্ঞানিক নাম Dendronanthus indicus। মাপ ১৮ সেন্টিমিটার। মাথার তালু-ঘাড়-পিঠ-কপাল ও লেজের উপরিভাগ চকচকে জলপাই-বাদামি, গলা-বুক-পিঠ ও লেজের তলা তুলোট সাদা—শুধু গলার নিচে একটা চওড়া-কালো বক্ষবন্ধনী আছে। সেই বন্ধনীর নিচে আবার আরেকটি অসম্পূর্ণ বক্ষবন্ধনী। চোখের ওপরে ও নিচে সাদা রেখা টানা। ডানায় চওড়া কালো ব্যান্ডের পাশে কম চওড়া সাদা ব্যান্ড আছে দুটি। পা ও ঠোঁটের রং ঘোলাটে—কালচে। বন খঞ্জন সুন্দর-চঞ্চল এক পাখি। আমাদের দেশে শরৎ-শীতের পরিযায়ী পাখি। প্রাকৃতিক বন তথা গ্রামীণ বন-বাগানসমৃদ্ধ এলাকায় বেশি দেখা যায়। প্রিয় চারণক্ষেত্র নারকেল-সুপারি বাগানের সুঁড়িপথ, আখমহল, বাঁশমহল, গম-ভুট্টার খেত, পানের বরজ, বনের ভেতরের ফাঁকা জায়গাসহ অন্যান্য স্থান। শিশিরের জল পান করতে ভালোবাসে খুব—শিশির-স্নানও করে। ভারতের আসাম-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য দেশে বাস করে।

No comments:

Post a Comment