Monday, January 12, 2015

তুরাগতীরে লাখো কণ্ঠে আমিন আমিন ধ্বনি:প্রথম অালো

আকাশ ছিল ঘন কুয়াশায় ঢাকা, থেকে থেকে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছিল গায়ে কাঁটা দেওয়া কনকনে হাওয়া। তা সত্ত্বেও ভোর থেকেই গায়ে গরম কাপড়, টুপি-মাফলারে কান-মাথা ঢেকে অসংখ্য মানুষ যাচ্ছিলেন তুরাগ নদের পাড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল এই জনস্রোত। রাজধানীতে এটি বেশ চেনা দৃশ্য। বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে তুরাগমুখী এই মানুষের ঢল। মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ২০১১ সাল থ
েকে দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গতকাল রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের প্রথম পর্বের ইজতেমা সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ১৬ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। গতকাল আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বরাবরের মতোই ভোর থেকেই ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে বেশুমার মানুষ ইজতেমা মাঠের দিকে যাত্রা শুরু করেন। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যেই মোনাজাত শুরু হবে। সে কারণে যাঁরা ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি, শুধু আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে চান, তাঁরা একটু আগেভাগেই ঘর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। সকাল নয়টা নাগাদ টঙ্গী সেতু থেকে বিমান-বন্দরের সামনে অবধি সড়ক জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কুড়িল বিশ্বরোড থেকেই যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পথের দুই পাশে খানিক পরপরই টাঙানো ছিল মাইক। তাতে শোনা যাচ্ছিল মোনাজাতের আগে শেষ পর্যায়ের হেদায়েতি বয়ান। লোকজন পথের বিভাজকের ওপর, দুই পাশে এবং একপর্যায়ে সারা পথে বসে পড়েছিলেন খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা যে যা পেয়েছেন তাই বিছিয়ে। সকাল ১০টা নাগাদ ফিকে হয়ে এসেছিল কুয়াশার পর্দা। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়াল থেকে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছিল সূর্য। এ রকম পরিবেশেই বেলা ১১টা ১৬ মিনিটে শুরু হলো আখেরি মোনাজাত। দিল্লির মওলানা সা’দ আবেগময় কণ্ঠে আরবি ও উর্দুতে প্রার্থনা করেন ‘হে আল্লাহ হাম সবকো মাপ ফরমাদে, তুঁম্ তো মাপ করনেওয়ালা। তুঁ হামছে রাজি হো জা। হে আল্লাহ সবকো কবুল ফরমালে। না রাজি কামছে হেফাজত ফরমাদে। হাম সবকো হেফাজত ফরমাদে। ইয়া আল্লাহ তুঁ হামারা দোয়া কুবুল ফরমাদে। ইয়া আল্লাহ হামারি ইমানকি হাকিকত হাসিল নছিব ফরমাদে। হামারি দোয়াকো কবুল ফরমাদে। গুনাহ মাপ ফরমাদে।’ প্রতিটি বাক্যের পর লাখো মুসল্লি ‘আমিন’, ‘আমিন’ বলে পরম করুণাময়ের কাছে দোয়া কবুলের জন্য মিনতি করেন। বেলা ১১টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত মোনাজাতে ব্যক্তিজীবনের গুনাহ মাফ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এবং দেশ, জাতি ও বিশ্বের শান্তি কামনা করা হয়। হেদায়েতি বয়ান: গতকাল সকাল নয়টা থেকে মোনাজাতের আগে চলে হেদায়েতি বয়ান। বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা’দ। তার বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা হাফেজ যোবায়ের। বয়ানে তিনি বলেন, নামাজ হলো সবচেয়ে উঁচু আমল। নামাজ ছাড়া ইসলাম কল্পনা করা যায় না। আল্লাহর ভান্ডার থেকে কিছু নেওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় হলো নামাজ। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার নারী ইজতেমা ময়দানের আশপাশ, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। ভিআইপিদের মোনাজাতে অংশগ্রহণ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাও শরিক হন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানের নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। খালেদা জিয়ার প্রেস শাখার কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানিয়েছেন। বিশ্ব ইজতেমায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাংসদ জাহিদ আহসান। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার বিশ্ব ইজতেমার মোনাজাতে মঞ্চের কাছে বসে মোনাজাতে অংশ নেন। আখেরি মোনাজাতে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের কূটনীতিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শরিক হন। এ ছাড়া পদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দল-মত-শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানও অংশ নেন। বিদেশি মেহমান ৩৫ হাজার: এবার তাবলিগ জামাতের প্রায় ৩০ হাজার বিদেশি মেহমান ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেছেন। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে তাবলিগ সূত্র। আরও তিন মুসল্লির মৃত্যু: শনিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আরও তিন মুসল্লি মারা গেছেন। তাঁরা হলেন ঢাকার বংশালের ছিদ্দিক বাজার এলাকার সিরাজ মিয়া (৫০), সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার সামির উদ্দিন (৭৫) এবং ঢাকার দোহার এলাকার কাসেম আলী (৫৭)। মোনাজাত শেষে যানজট ও জনজট : আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আশা মুসল্লিরা দ্রুত নিজ জেলায় ফেরার চেষ্টা করেন। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট।

No comments:

Post a Comment